ভাষা মতিনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ
মহান ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সিরাজগঞ্জের কৃতী সন্তান আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য জাতির কাছে তিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত। আজ ৮ অক্টোবর তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৫২ সালে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথিবীতে যেসব আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙালির ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্ঠতম। এ কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মর্যাদায় দিবস হিসেবে পালিত হয়। তৎকালীন সময়ে আবদুল মতিন ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন।
আবদুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত চৌহালী উপজেলার ধুবালীয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। জন্মের পর তাঁর ডাক নাম ছিল গেদা।
আবদুল মতিন দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় এবং ১৯৪৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন। এ সময় তিনি আইন অনুষদেও ভর্তি হন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সরকার পোস্টাল স্ট্যাম্প, পোস্ট কার্ড, মনিঅর্ডার ফরম এবং খামে বাংলার পরিবর্তে উর্দুভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। নিম্ন আয়ের সরকারি চাকরিজীবীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। আবদুল মতিন তাঁদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হন।
বাংলা ভাষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা দিবসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় পুলিশ আবদুল মতিনকে গেপ্তার করে দুই মাসের কারাদণ্ড দেয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁকে জানানো হয়, তিনি সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু চাকরির শর্ত তাঁর কাছে অসম্মানজনক মনে হওয়ায়, এতে যোগ দেননি তিনি। আটকের মেয়াদ শেষ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেন আন্দোলন করবেন না মর্মে তাঁকে মুচলেকায় সই করতে বলেন। এতে অস্বীকৃতি জানান আবদুল মতিন এবং এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন বছরের জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবদুল মতিনের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়ে ওই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে।
১৯৫০ সালের ১১ মাচের্র এক জনসভায় আবদুল মতিন বলেছিলেন, ‘আমাদের এখন মাতৃভাষার রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর এই কাজটা ছাত্ররাই করতে পারে। প্রথমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকামী ছাত্রসংগঠনগুলিকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে। এই সংগ্রাম কমিটি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুরূপ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলবে।’
‘ছাত্রদের সংগঠিত শক্তির মাধ্যমে আন্দোলনকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে যাতে জনগণ ধাপে ধাপে শামিল হতে পারে। এইভাবে ছাত্র ও জনগণের শক্তিতে আন্দোলন এমন দুর্বার হয় উঠবে যে শাসকরা মাথা নত করতে বাধ্য হবে।’
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবসের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ছাত্রদের একটি সভায় আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হলে মতিন আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরে আন্দোলন ফলপ্রসূ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের উর্দুপ্রীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রয়ারি ও ২১ ফেব্রুয়ারি আবদুল মতিন দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের ডাক দেন। সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। মতিনসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা বাংলার জন্য আন্দোলনের যেসব কর্মসূচি গৃহীত হয়। এর পরের ইতিহাস বাঙালির অস্তিত্ব, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যেও ২২ ফেব্রয়ারি শহীদদের জন্য গায়েবানা জানাজায় সঙ্গীদের নিয়ে অংশ নেন আবদুল মতিন।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের নিয়ে ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে রাত জেগে ছাত্ররা তৈরি করেন শহীদ মিনার। ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার একটি গোপন বৈঠক থেকে অন্য ভাষা সংগ্রামীদের সঙ্গে আবদুল মতিনকেও গেপ্তার করা হয়। পরের বছর ১৪ মার্চ তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে’র সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল মতিন। ১৯৫৪ সালে তিনি পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। মওলানা ভাসানী ‘ন্যাপ’ গঠন করলে তিনি ১৯৫৭ সালে সেখানে যোগ দেন।
আবদুল মতিন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত বয়সের কাছে হার মানেন ভাষা সংগ্রামের অকুতোভয় এই যোদ্ধা। নিজের চোখের কর্নিয়া সন্ধানীকে এবং দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন ভাষা মতিন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর। তিনি স্ত্রী গুলবদন নেসা, দুই মেয়ে মতিয়া বানু শুকু ও মালিহা শুভসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার মতো এত সুন্দর ভাষা পৃথিবীর কোথাও নেই। বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। এই বাংলার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, এই বাংলাকে ভালোবাসি। বাঙালি না হলে যুদ্ধ হতো না। আমরা বাঙালি হয়েছি বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।’
ভাষা মতিনের লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থ
ভাষাসৈনিক হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল মতিন বহু গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাঙ্গালি জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন কী এবং কেন, ইউরোপের দেশে দেশে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, এবং জীবন পথের বাঁকে বাঁকে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে নানা সময় নানা পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দৈনিক জনকণ্ঠ গুণীজন ও প্রতিভা সম্মাননা ১৯৯৮, ২০০ সালে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ২১ ফেব্রয়ারি উপলক্ষে সংবর্ধনা, একুশে পদক ২০০১, ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ফেলোশিপ, ২০০২ সালে বাংলাদেশ জাতিয় জাদুঘর কর্তৃক সম্মাননা স্মারক, ২০০২, ভাষা সৈনিক সম্মাননা পরিষদ, সিলেট কর্তৃক ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা প্রদান, ২০০২, আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার, ২০০৩, জাতিয় প্রেসক্লাব কর্তৃক উন্নয়ন অর্থনীতি স্বর্ণপদক ২০০৪, ১৩ আগস্ট, ২০০৪, শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার, ২০০৪, মুক্তিযুদ্ধ গণপরিষদ কর্তৃক সম্মাননা, ১৪ মে, ২০০৫। এছাড়াও তিনি বহু পুরস্কার, সম্মননা পেয়েছিলেন।