‘মেয়েগোরে আর পাঠায়েন না’
‘মা, তুমি আয়শারে (দালাল) পিঠমোড়া দিয়া বান্ধ, আমারে পাচার কইরা দিছে মা। জানি না, জীবনে ফিরতে পারব কি না, আল্লা-আল্লা করো। আমি যে কত কষ্টে আছি মা, তুমি জানো না। ঘরের মধ্যে আটকাইয়া রাখে, খাওন দেয় না, মারধর করে, অত্যাচার করে।’
মোবাইল ফোনে কাঁদতে কাঁদতে মাকে এভাবে বলতে থাকেন আঞ্জুয়ারা খাতুন, ‘এইহানে আরো ৫০ জন আছে, নানান দ্যাশের। সগলের একই অবস্থা। বাংলাদেশের মেয়েগোরে আপনারা আর পাঠায়েন না। মা, আমার এই কথা সগলরে শুনাইও। দালালরে কও, আমারে যেন দ্যাশে নিয়া যায়। আর আয়শারে পিঠমোড়া দিয়া বান্ধ মা।’urgentPhoto
সম্প্রতি ওমান থেকে করা ফোনে আঞ্জুয়ারা এ আকুতি জানান। তিনি পাচারের শিকার হয়েছেন। তাঁর বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার গাজীপুর গ্রামে। বাবার নাম রবিউল ইসলাম।
আট বছর আগে দুই সন্তানসহ আঞ্জুয়ারাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তাঁর স্বামী। আশ্রয় নেন দরিদ্র পিতা-মাতার সংসারে। টানাটানির সংসারে একপর্যায়ে একই গ্রামের নূর হোসেনের মেয়ে আয়েশা খাতুন ভালো চাকরিসহ দুবাই পাঠানোর প্রলোভন দেন। পরিবারের সহায় বলতে যে একটুকরো জমি ছিল, তা বন্ধক রেখে আয়েশার হাতে দেড় লাখ টাকা তুলে দেন আঞ্জুয়ারা। কিন্তু আয়েশা তাঁকে দুবাই না পাঠিয়ে ওমানে এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেন। গত পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে সেখানে তাঁর ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন।
আঞ্জুয়ারার বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘দুবাই নেওয়ার কথা বলে দেড় লাখ টাকা নিছে। কিন্তু ওমানে দালালদের কাছে বেইচে দিছে। এখন আরো এক লাখ টাকা চাচ্ছে। দিতে পারছি না বলে আমার মেয়ের ওপর অত্যাচার করছে।
পাঁচ মাস হলো আমার মেয়ের কোনো খবর নেই। এ ঘটনা লোকজনরে বলায় ওরা উল্টো আমাদের নামে মামলা দিয়েছে। পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিবারের সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এখন আমি কী করব? আমার মাইয়েরে কীভাবে ফেরত আনব?’
তবে আঞ্জুয়ারাকে বিদেশে পাচারের কথা অস্বীকার করেছেন আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই সব সময় দালালের মাধ্যমে যাই। কিন্তু ও কোন দালালের মাধ্যমে গেছে, আমি তার কিছুই জানি না। এটাই আমার সত্যি কথা।’ আঞ্জুয়ারার পরিবারের নামে মামলা করেছেন কেন—জানতে চাইলে আয়শা বলেন, ‘ওরা মামলা করেছে, তাই আমরাও করেছি।’
আঞ্জুয়ারার মতো যশোর অঞ্চলের শতাধিক নারীর বন্দিজীবন কাটছে ওমানে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনের পরিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহায়তা চেয়ে আবেদনও করেছে। ওমানে আটকে থাকা যশোর সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের সাথী বেগমের স্বামী কবির হোসেন বলেন, ‘আমার ওয়াইফ কানতে কানতে বলতেছে, আমারে খুব মারতেছে, আমারে বাঁচাও, আমি তো অসহায় হয়ে পড়তিছি। সবাই হাত-পা ধরতিছি, কেউ টাকা দেচ্ছে না। এক জায়গা থেকে সুদে ৪০ হাজার, আরেক জায়গা থেকে ১০ হাজার নিয়ে দিইছি। এখন আরও ৬০ হাজার চাচ্ছে দালাল তফিকুল মণ্ডল। আমি চার দোকান দিয়ে সংসার চালাই। প্রথমে দেড় লাখ টাকা তো দিছিই। এখন ৪০ হাজার টাকায় প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা সুদ দিতি হবে। আমার তো সব শেষ। আমি এখন কী করব?’
মানব পাচার প্রতিরোধে যশোর অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে রাইটস যশোর নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন। এর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যশোরে মানব পাচারের অভিযোগে ৩৭২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬টি মামলার রায় হয়েছে। একটিতেও কারো সাজা হয়নি। পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত এবং সাক্ষীদের ঠিকমতো হাজির করতে না পারার কারণেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া মামলা চলাকালে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দুই পক্ষের মধ্যে টাকা-পয়সার মাধ্যমে মীমাংসা করিয়ে ফেলছে। এ কারণে মানব পাচারকারীদের শাস্তি হচ্ছে না।
বিনয় আরো বলেন, ‘কদিন আগেও শুনছিলাম, শুধু মনিরামপুর ও ঝিকরগাছা উপজেলা থেকেই দুই-আড়াই হাজার নারী-পুরুষ পাচারের শিকার হয়েছে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, যশোর জেলা থেকে সাত/আট হাজার নারী-পুরুষ পাচার হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে আমরা তাদের অনুরোধ করেছি, ওসি ও ইউএনওদের মাধ্যমে তারা যেন পাচারের শিকার নারী-পুরুষের সংখ্যা বের করার চেষ্টা করেন।’
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বলেন, ‘যশোর থেকে কতজন মানব পাচারের শিকার হয়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আগে তো কেউ অভিযোগ করতে আসেনি। এখন আসছে। পাচারের শিকার হওয়াদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি আমরা।’
সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিক ও মিয়ানমার জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে থাইল্যান্ডের জঙ্গল ও সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো কয়েক হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে যশোর থেকে পাচারের শিকার লোকজন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে গেছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।