ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত হয়েছিল আজ
আজ ৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালে এই ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ এই দিন ভোরে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। শুরু হয় বিজয়ের উল্লাস।
এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে ২৫ হাজার নারী-পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন দুই হাজার মা-বোন।
২৭ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হন রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার সদস্যরা। ২৯ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআরের সুবেদার কাজিম উদ্দিন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে হাবিলদার বদিউজ্জামানের সহায়তায় অস্ত্রাগারে হামলা চালান। তাঁরা সমস্ত অস্ত্র বাঙালি সেনাদের হাতে তুলে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর নির্দেশে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার পুরোপুরি বাঙালিদের দখলে চলে আসে। তখন থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রশাসন পরিচালিত হতে শুরু করে তৎকালীন সংসদ সদস্য আলহাজ ফজলুল করিমের নির্দেশে।
ওই সময় ১০টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য ২০টি জায়গা নির্ধারণ করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
১০ এপ্রিল থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে অন্যান্য মহকুমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সেনারা শক্ত ঘাঁটি করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন সংগ্রাম কমিটি ১৩ এপ্রিল তাদের কন্ট্রোল রুম ও ২০টি প্রতিরোধ ক্যাম্প তুলে নিয়ে সীমান্তে অবস্থান নেয়। নেতারা শহর ছেড়ে চলে যান।
১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও। হানাদার সেনারা ১০টি ট্রাক ও আটটি জিপে করে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে।
ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয় জুলাই মাসের প্রথম দিকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন। বেশ কিছু সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেন তাঁরা। দালাল-রাজাকারদের বাড়ি ও ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালান। ২১ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয় বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর থানা অঞ্চলে। এ যুদ্ধে বেশির ভাগ ফলাফল মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে আসে।
মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানে পঞ্চগড় মুক্তিবাহিনীর দখলে এলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানি সেনারা ৩০ নভেম্বর ভূল্লঙ্গী সেতু উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকায় সর্বত্র, বিশেষ করে ইক্ষু খামারে মাইন পুঁতে রাখে। মিত্রবাহিনী ভূল্লঙ্গী সেতু সংস্কার করে ট্যাঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ভূল্লঙ্গী সেতু পার হলেও মিত্রবাহিনী যত্রতত্র মাইন থাকার কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে পারেনি। ওই সময় শত্রুদের মাইনে দুটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর এফএফ বাহিনীর কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়।
২ ডিসেম্বর সারা রাত প্রচণ্ড গোলাগুলির পর শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে শত্রুমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও।