এখন ল্যাপটপ দিয়ে পড়বেন খোকন
হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে মাস গেলে মাত্র তিন হাজার টাকা রোজগার। তবে সংসারের টানাপড়েন আর পাওয়া না পাওয়ার শত বঞ্চনাও আটকাতে পারেনি তার লক্ষ্যকে। নিষ্ঠুর দারিদ্র্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঠিকই চালিয়ে নিচ্ছেন সন্তানের পড়াশোনা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রয়োজন নেই।
সংগ্রামের এ গল্প বরগুনার রুনু বেগমের। সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যেও পরম মমতায় আগলে রেখেছেন আদরের দুই সন্তানকে। হয়তো সন্তানদের কোনো বিলাসের জীবন দিতে পারছেন না তবে খেয়ে না খেয়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছেন ঠিকই। তাঁর কষ্টের প্রতিদানও দিচ্ছে ছেলেমেয়েরা। একমাত্র ছেলে পড়ছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে আর মেয়ে স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণিতে।
সম্প্রতি ছেলে খোকনের পড়াশোনার প্রয়োজনে একটি ল্যাপটপের দরকার হলে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন মা রুনু বেগম। তবে সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি ঠিকই অবিচল। প্রয়োজনে স্বামীর ভিটেটুকু বেচেই ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন, দরকারে রাস্তার পাশে ছাপড়া বানিয়ে সেখানেই ছেলেমেয়ে আর পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে থাকবেন।
তবে মানুষের সৎ প্রচেষ্টা বৃথা যায় না কখনোই। হতদরিদ্র মায়ের এ সংগ্রামের কথা জানতে পেরে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম। নিজের বেতনের টাকায় রুনু বেগমের ছেলে খোকনের জন্য একটি ল্যাপটপ কিনে দেন তিনি।
গত রোববার সন্ধ্যায় একরকম নীরবেই নিজের অফিসে ডেকে এনে মা আর ছেলের হাতে ল্যাপটপ তুলে দেন জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম। স্বপ্নের ল্যাপটপ পেয়ে কেঁদে ফেলেন খোকন। কাঁদেন মা রুনু বেগমও।
বরগুনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ আহমেদ বলেন, ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ চুক্তিতে রুনু বেগম তাঁর বিদ্যালয়ের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য রুনু বেগমের প্রচেষ্টার কথা তাঁর বিদ্যালয়ের সবারই জানা। তাঁর এ দুঃসময়ে জেলা প্রশাসকের দেওয়া এ সহযোগিতা তাঁকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে বলে মনে করছেন এ প্রধান শিক্ষক।
বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসানুর রহমান জানান, নিজের চেষ্টা থাকলে বিধাতাও তাঁর সহায় হন। রুনু বেগম তার উদাহরণ।
রুনু বেগমের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের রায়েরতবক গ্রামে। তাঁর স্বামী আবদুল গনি ঘরামী পাঁচ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েন। সেই থেকে একার রোজগারেই কোনোমতে চার-চারটি প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছেন রুনু বেগম। বড় ছেলে মো. খোকন বরিশাল চাঁদমারী এলাকার একটি বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ছোট মেয়ে লিনা রায়েরতবক স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী।
জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘রুনু বেগমের কাছ থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। ছেলেমেয়ে সুশিক্ষিত করতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার যে প্রয়োজন নেই, তা দরিদ্র মা রুনু বেগম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘একাডেমিক পড়াশোনার জন্য এখন ল্যাপটপ অপরিহার্য একটি সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সব অলিগলিতে প্রবেশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ল্যাপটপ।’ তাই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ব্যক্তিকে তিনি দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।