গরু-ভেড়া ও হাঁস নিয়ে গবেষণায় দেশের বিজ্ঞানীদের সাফল্য
মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম জাতের গরুর জিন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির (এনআইবি) বিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি তারা দেশি জাতের ভেড়া ও হাঁসের জিনোম সিকোয়েন্সও বের করেছেন।
দেশে মূলত চারটি স্থানীয় জাতের গরু পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে নর্থ বেঙ্গল গ্রে ক্যাটল, পাবনায় জার্সি, মুন্সীগঞ্জে মীরকাদিম ও চট্টগ্রামে রেড ক্যাটল গরু।
এনআইবির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক ড. মো. সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল এই তিন প্রাণীর জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় এনআইবিতে সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রাণীর পূর্নাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের বিষয়টি জানান বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
এই তিন প্রাণীর জীবনরহস্য উন্মোচনের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. মো. সলিমুল্লাহ বলেন, ‘এটা আমাদের এই গবেষণার প্রাথমিক একটি ধাপ। যেমন, মীরকাদিম গরুর জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী। আমরা দেখেছি—অন্যদের থেকে এই গরুগুলো খাবার কম খায়, তবে এদের বৃদ্ধি বেশি। আমাদের দেশে প্রোটিনের ঘাটতি রয়েছে। মীরকাদিম গরুর জিনে যেসব অ্যানোটেশনের কারণে অধিক মাংস উৎপাদিত হয়ে থাকে, সেগুলো শনাক্ত করে তা অন্য প্রজাতির গরুতে প্রতিস্থাপন করতে পারব। এর ফলে আমাদের দেশে প্রোটিনের যে সমস্যা, সেখান থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে পারব।’
এই গবেষক দলে আরও ছিলেন সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিক্স প্রকল্প পরিচালক ও সিইও কেশব চন্দ্র দাস, এসএসও ড. নুসরাত জাহান, ড. আঞ্জুমান আরা ভূঁইয়া, ড. ইউ এস মেহজাবিন আমিন, এসও মো. হাদিসুর রহমান, মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন, ইসতিয়াক আহমেদ, তাহমিদ আহসান, জিসান মাহমুদ চৌধুরী ও অরিত্র ভট্টাচার্য।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য তুলে ধরে এনআইবির বায়োইনফরম্যাটিকস বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি, দেশি মীরকাদিম গরুর চোখের পাতা ও খুর গোলাপি, ত্বক সাদা, লেজের অগ্রভাগ বাদামি, শিং মাঝারি বাঁকা ও অগ্রভাগ সূক্ষ্ম। অপরদিকে, প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার ওজন ২০ কেজি, লোম মসৃণ ও বিন্যস্ত। এছাড়া হাঁসের রং হয় বাদামি, কালো ও সাদা পালকের মিশ্রণ, ঠোঁটের রং হয় হলুদাভ কালো, পায়ের পাতা হয় উজ্জ্বল কমলা রঙয়ের।”
এই গবেষণা করতে সব মিলিয়ে কতদিন সময় লেগেছে জানতে চাইলে উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘এই গবেষণাটি করতে আমাদের সাত মাসের মতো সময় লেগেছে। এতে গরুর জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২২৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৬ জোড়া নিওক্লিউটাইড পাওয়া গেছে। মীরকাদিম জাতটির ভারতের জেবু জাতের সঙ্গে মিল রয়েছে। এছাড়া এটির নিজস্ব জেনেটিক বৈশিষ্ট্যও উঠে আসে এ গবেষণায়। গরুর মাংস উৎপাদন সংক্রান্ত পাঁচটি জিনের তথ্য আমরা পেয়েছি, যা মাংস উৎপাদনের তথ্যে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে, ভেড়ার জিনোম বিশ্লেষণ করে ২৮৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড এবং হাঁসের জিনোম বিশ্লেষণ করে ১৩৩ কোটি ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে।’
উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘আমাদের গবেষণার এসব তথ্য গত ২৩ মার্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে নিবন্ধন করা হয়েছে। বিদেশি কোনো জার্নালে গবেষণার ফল প্রকাশ করতে গেলে এই নিবন্ধনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে অনুমোদনের সঙ্গে একটা কোডও দেওয়া হয়, যেটি বিদেশি জার্নালে লাগে। ইটোমধ্যে আমরা নিবন্ধন পেয়ে গেছি। এখন জার্নালে প্রকাশের জন্য লেখার কাজ চলছে। শিগগিরই সেটা শেষ হবে।’
এই গবেষণা নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে বেশ টাকা ব্যয় করে আমরা এখানে একটি জিন ব্যাংক করেছি। দেশের যত পশু-পাখি, গাছপালা রয়েছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং অরিজিনাল বিষয়গুলোকে রক্ষা করতেই আমরা এই জিন ব্যাংক তৈরি করেছি। আমরা কিন্তু সার্বিকভাবেই এই দেশটাকে নিয়েই ভাবি। দেশের মাটি, মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা সবকিছুই কিন্তু বায়োটেকনোলজির মধ্যে পড়ে। তাই আমরা চাচ্ছি, দেশে আমাদের যেই জিনিসগুলো রয়েছে, সেগুলোকে ভালোভাবে জানতে, যেন আমরা বিশ্বের কাছে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে পারি যে, দিজ আর ইউনিক ইন বাংলাদেশ।’
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে দুই কোটি ৫৭ লাখ গরু, ১৯ লাখ ভেড়া ও তিন কোটি ৪১ লাখ হাঁস রয়েছে। মোট জিডিপির প্রায় দুই দশমিক নয় শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে আসে, যা মোট বার্ষিক প্রবৃদ্ধির পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ গবাদি প্রাণী, হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে শুধু গরু-মহিষ পালন করছে ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। ছাগল-ভেড়া ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ও হাঁস-মুরগি পালন করছে ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। এ গবেষণার ফলে এই খাতে আরও সম্ভাবনা বাড়বে।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে পাট, মহিষ, ইলিশ, করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন জীবাণুর জেনোম সিকোয়েন্স ঘোষণা করা হলেও বেশির ভাগই বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব সিকোয়েন্সের অধিকাংশের অ্যাসেম্বলিং ও অ্যানোটেশনের কাজও বিদেশি সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে। এবারই প্রথম দেশি ল্যাবে গবেষণা সম্পন্ন হলো।
জীন রহস্য কী? এর রহস্য জানলে কী উপকার হয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সুরাইয়া পারভীন এ সম্পর্কে বলেন, ‘জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। জীবের অঙ্গসংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ যেসব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেগুলোর নির্দেশনা জিনোমে সংরক্ষিত থেকে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সব নিউক্লিওটাইডগুলো (জৈবঅণু) কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা নিরূপণ করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়। আর এখন তো মানুষেরও জীন রহস্য বের করে চিকিৎসা করা হচ্ছে। ফলে এই জীন রহস্য জানা খুবই প্রয়োজন।’
ড. মো. সলিমুল্লাহ বলেন, ‘মানুষের চিকিৎসায় জীন থেরাপি এখন শুরু হয়েছে। ফলে দেশের মানুষকে তার জীন রহস্য জানতে ভারতে বা বিদেশে যেতে হয়। এটা অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আমরা এখানে মানুষেরও জীন রহস্য নিয়ে কাজ করব, যাতে এটা করতে তাদের আর বিদেশে যেতে না হয়। একজন মানুষের যদি জিন রহস্য জানা থাকে, তাহলে তার চিকিৎসায় অনেক কাজে লাগবে।’
২০২১ সালের জুলাই মাসে ৪৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এনআইবিতে সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিকস প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীবসম্পদের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গবেষণাগার, তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্য সংরক্ষণাগার গড়ে
তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি দেশি জাতের এই তিন প্রাণির জিন রহস্য উদঘাটনে গবেষণা শুরু হয়েছিল।