দেহে রাবার বুলেট-ছররা গুলির ৯২ ক্ষত, নষ্ট হওয়ার পথে ডান চোখ
দেহে রাবার বুলেট ও ছররা গুলির ৯২টি ক্ষত। নিষ্ঠুরতা থেকে বাদ পড়েনি চোখও। ডান চোখে ছররা গুলি ঢুকে আটকে আছে চোয়ালের হাড়ে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভর্তি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিট ও হাসপাতালের বেডে। বলছিলাম মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবের কথা। হাসপাতালে আছেন প্রায় দুই সপ্তাহ। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
আজ শনিবার (১৭ আগস্ট) হাসপাতালের ৬১৬ নম্বর কেবিনে থাকা সৈয়দ হাসিবের সঙ্গে তার শিশু সন্তান সৈয়দ সামিন রাইয়ান, স্ত্রী সাবরিনা মম শম্পা ও বাবা এস এম গোলাম মোত্তর্জা ছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ ঠিকমতো ঘুম নেই। প্রিয় স্বজনের চিন্তায় ভুলে গেছেন নাওয়া-খাওয়া।
জানা গেছে, ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে ছাত্র–জনতার সমাবেশে সেদিন নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। সাভারে শুরু হয় গণহত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি। পুলিশর গুলিতে সেদিন মারা যান অর্ধশতাধিক মানুষ, গুলিবিদ্ধ হন তিন শতাধিক। একের পর এক গুলিবিদ্ধ হতাহতদের নেওয়া হয় হাসপাতালে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে দেশত্যাগের খবরে পিছু হটে পুলিশ। ছাত্র-জনতা ঘেরাও করে সাভার থানা। সেখানেও নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। এর আগেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোঁড়া হয়। গুরুতর অবস্থায় প্রথমে তাকে নেওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার চিকিৎসায় জরুরি ভিত্তিতে খবর দেওয়া হয় চক্ষু বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু উত্তাল পরিস্থিতিতে তারাও সময়মতো আসতে পারেননি। ততক্ষণে চোখের ভেতর রক্তপাত হতে হতে তা জমাট বেঁধে যায়। ক্রমেই শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে সৈয়দ হাসিবকে পরদিন ভোরে স্থানান্তর করা হয় রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিট ও হাসপাতালে। সেখানে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার হয়। তবে, চোখের দৃষ্টিশক্তি আদৌ ফিরে পাবেন কি না, তা নিশ্চিত নন চিকিৎসকরাও। তবে, এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি কোনো চিকিৎসক।
ঘটনা সম্পর্কে সৈয়দ হাসিব বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় দেখলাম পুলিশের উপর্যুপরি গুলিতে দুজন মারা গেলেন। একপর্যায়ে আমার দিকে তেড়ে আসেন এক পুলিশ সদস্য। আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে উদ্যত হয়। আমি নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বলি, ভাই আমি সাংবাদিক। মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করি। ওই পুলিশ সদস্য মারমুখী আচরণ থেকে কিছুটা সরে যায়। পেছনে থাকা পুলিশের গাড়ি থেকে জিজ্ঞাস করা হয়, আমি কে? পুলিশ সদস্য বলেন, স্যার সাংবাদিক। তখন গাড়ি থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা অশ্লীল গালি দিয়ে আমাকেই গুলি করতে বলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে নিশানা করে খুব কাছ থেকে সেই পুলিশ সদস্য গুলি করে। আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার ফোনটিও খোয়া যায়। তারপর নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করি।’
সৈয়দ হাসিবের অভিযোগ, ‘ওয়্যারলেসে আমাকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির বন্ধু ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ হিল কাফী। এ ছাড়া ওই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম ও সাভার মডেল থানা থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান। আমার জীবনটাকে আজ ওরা অন্ধকার করে দিয়েছে। আমি ওদের বিচার চাই।’
হাসিবের বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এস এম গোলাম মোত্তর্জা বলেন, ‘আমার একটি মাত্র ছেলে। তার সারা দেহে ৯২টি বুলেটের ক্ষত। বাবা হিসেবে ছেলের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না।’
মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘আমাদের সহকর্মিকে এভাবে গুলি করার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। সৈয়দ হাসিবের পাশে মাছরাঙা পরিবার রয়েছে।’
গুলিবিদ্ধ আহতদের দেখতে গত সোমবার (১২ আগস্ট) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে। সাংবাদিক হাসিবের শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতা, এমনকি সাংবাদিকদেরও নির্বিচারে গুলি করেছে। কতটা বর্বর হলে পুলিশ এমন কাজ করতে পারে।’