লাখপতির গল্প
আচার বেচে লাখপতি বরিশালের ‘আচার আপু’ রুবি
অনলাইনের মাধ্যমে আচার বেচে লাখপতি বনে গেছেন বরিশালের মেয়ে রুবি আফরোজ। এখন তাঁকে সবাই চেনে ‘আচারওয়ালি’ নামে। কেউ বা ডাকেন ‘আচার আপু’। রুবির উদ্যোক্তা-জীবন এক বছর নয় মাস। এখন তাঁর বেতনভুক্ত কর্মী পাঁচ জন। এ ছাড়া তাঁর বাবা-মা, ভাই ও স্বামী সহায়তা করেন তাঁকে।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় রুবি আফরোজের। বলেন তাঁর উদ্যোক্তা-জীবনের গল্প। কুশল জানতেই রুবির উত্তর, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। সংসার, সন্তান, নিজের সন্তান সমতুল্য দুই উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি।’
রুবি বলেন, ‘আমি বরিশালের মেয়ে। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সব কিছু বরিশালে হলেও গত তিন বছর ধরে স্বামীর কর্মসূত্রে ঢাকায় অবস্থান করছি। বর্তমানে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড থেকে আমার উদ্যোগ পরিচালনা করছি। আমার সন্তান সমতুল্য দুটো উদ্যোগ। আমার প্রথম উদ্যোগ আনশি চয়েস-এর জন্ম ২০১৯ সালের ২০ জুন আর আমার দ্বিতীয় উদ্যোগ রসনা বিলাস-এর জন্ম ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। আমি প্রথমে গার্মেন্টস বেইজ এক্সপোর্ট কোয়ালিটির দেশে তৈরি কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে আনশি চয়েস-এর যাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমার সব সময়ই মনে হতো, এতে তো আমার ক্রিয়েটিভিটির প্রকাশ ঘটাতে পারছি না।’
‘আমি কিনে এনে বিক্রি করছি, মানে আমি একজন ব্যবসায়ী কিন্তু উদ্যোক্তা হতে পারিনি। আর এ চিন্তা থেকেই আমার রসনা বিলাস-এর যাত্রা। আমি ছোটবেলা থেকে আচার বানাতে ভালোবাসি। তাই আমি চিন্তা করলাম, আচার নিয়েই শুরু করব আমার নতুন উদ্যোগ। কারণ, ভালোবেসে করা যেকোনো কাজেই থাকে আন্তরিকভাবে করার প্রচেষ্টা। আর আন্তরিকভাবে ভালোবেসে করা কাজ নিয়ে এগিয়ে গেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমিও আমার ভালোবাসার কাজ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ, উই-এ (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) আমি আচার বিক্রি করে লাখপতি সেলার হয়েছি। তাই আমি গর্ব করে বলি, আমি উই-এর আচারওয়ালি,’ যোগ করেন রুবি।
নারী উদ্যোক্তা হয়ে কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে রুবি আফরোজ বলেন, ‘এই অনুভূতি সবটা হয়তো বলে বোঝাতে পারব না। তবে আজ আমার একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে। আমি আত্মনির্ভরশীল হয়েছি। স্বাবলম্বী হয়েছি। কারও কন্যা, কারও বোন, কারও স্ত্রী, কারও মা; এই পরিচয়ের বাইরেও আমার একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে। আমি একজন নারী উদ্যোক্তা। কেউ ভালোবেসে বলে আচারকন্যা, কেউ আচারের রানি, কেউ আচার আপু। আজ আমি আমার নিজের আয়ে আমার কন্যাকে নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে দিতে পারছি, আমার সংসারে সাপোর্ট দিতে পারছি। নিজের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনকে কিছু দেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে টাকা চাইতে হচ্ছে না। সর্বোপরি আমার আজীবনের লালিত স্বপ্ন, নিজে কিছু একটা করব, নিজের পরিচয় তৈরি করব, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে।’
মূলত আচার নিয়ে কাজ করেন রুবি আফরোজ। বিভিন্ন ধরনের আচার বানান তিনি। রুবির ভাষ্যে, ‘কলিজা ও বাদামের আচার আমার নিজস্ব ক্রিয়েশন। কলিজার আচার আমার সিগনেচার আইটেম। উই-এ আমি শুধু আচারকেই ফোকাস করে পুরো এক বছর পারসোনাল ব্র্যান্ডিং করেছি। এ ছাড়া পরিচিতি পাওয়ার পরে আমি মিক্সড ড্রাই ফ্রুটস (কাস্টমাইজড) গৌরনদীর সন্দেশ, ঘি আর ফ্রোজেন ফুড নিয়ে কাজ করি। আর আনশি চয়েস পেজের নতুন সংযোজন দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি ও নরসিংদীর তাঁতে বোনা গামছা দিয়ে কুশির নেকের বেবি ড্রেস, নিজস্ব ইউনিক ডিজাইনের টপস, স্কার্ট এবং কাস্টমারদের চাহিদার ভিত্তিতে নিজস্ব ডিজাইনে গামছা দিয়ে তৈরি ইউনিক ফ্যামিলি কম্বো সেট।’
আয় সম্পর্কে রুবি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, দুই মাসেরও কম সময়ে আমি দারুণ সাড়া পেয়েছি। উই থেকে এখন পর্যন্ত আমার দুই লাখ টাকার বেশি সেল হয়েছে। যার মধ্যে রসনা বিলাস পেজ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকার সেল হয়েছে। কারণ, আমার দুটো উদ্যোগ থাকলেও আমি পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য পুরো এক বছরের বেশি শুধু একটা উদ্যোগকেই পরিচিত করেছি। আমি কিন্তু শুধু উই-এর সেলার নই। উই-এ আমার সেল হওয়ার আগেই আমি উই থেকে ১০ হাজার টাকার কেনাকাটা করেছি। এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় লাখের কাছাকাছি। তাই আমি শুধু উই-এর লাখপতি সেলার নই, আমি খুব ভালো বায়ারও বটে।’
পহেলা বৈশাখ ও পবিত্র ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রস্তুতি? রুবি বলেন, ‘বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। তাই যেকোনো উৎসবেই সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের থাকে নানা আয়োজন। আর উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ঘরে থাকে বিশেষ খাবারের আয়োজন। আর নতুন নতুন পোশাকে নিজেকে রঙিন করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। ঈদুল ফিতর আর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমিও নানান সিজনাল ফলসহ অন্যান্য ইউনিক সব আচারের পসরা নিয়ে আছি। আমার স্বপ্ন এবারের ঈদে ডাইনিং টেবিলে হরেক রকম খাবারের সাথে থাকবে আমার বানানো ফ্রেশ ও সুস্বাদু সব আচার। আর ছোট-বড় সবার পছন্দের পুষ্টিকর মিক্সড ড্রাই ফ্রুটস হতে পারে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার সময় সাথে নেওয়ার জন্য বেস্ট নাশতা। আমি এটাকে কাস্টমাইজড করি, যাতে এর স্বাদ অনেক বেড়ে যায়। আর স্বপ্ন দেখি আমার গামছা দিয়ে তৈরি ইউনিক ডিজাইনের পোশাকে সাজবে দাদু-নাতি, মা-বাবাসহ সবাই। আলহামদুলিল্লাহ, ইতোমধ্যে কিছু ড্রেসের অর্ডার পেয়েছি। কিছু ডেলিভারি দিয়েছি, কিছু প্রোডাকশনে আছে।’
কবে লাখপতি হয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রুবি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমি ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর লাখপতি হয়েছি। আমার উই-এ জয়েন করার ছয় মাস, মানে ১৫০ দিন পরে সেল হয়েছে। এই ছয় মাসে আমি একদম ধৈর্যহারা হইনি, অ্যাক্টিভিটিও কমিয়ে দিইনি। তাই আমি মনে করি, উই থেকে কিছু পেতে হলে বা লাখপতি হতে হলে ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে।’
উই-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ রুবি আফরোজ। বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণে উই-এর অবদান অপরিসীম। কৃতজ্ঞতা উই-এর জননী নাসিমা আক্তার নিশা আপুর প্রতি, যিনি লক্ষ নারীর স্বপ্ন পূরণের কারিগর। কৃতজ্ঞতা রাজিব আহমেদ ভাইয়ার প্রতি, যিনি শুরু থেকেই দিন-রাত উই-এর সাথে থেকে তাঁর মূল্যবান পরামর্শ ও জ্ঞান দিয়ে উই-কে সমৃদ্ধ করেছেন। নিশা আপু আমাদের অনুপ্রেরণা, পারিবারিক জীবনের নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের মতো নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিতে, এগিয়ে নিতে ছুটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।’
আগামী দিনের পরিকল্পনা কী। রুবি বলেন, ‘অনলাইনে রসনা বিলাসকে আচারের একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই। দেশীয় পোশাকের ক্ষেত্রে গামছা ডিজাইনের পোশাকের মাধ্যমে গামছাশিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে তাঁতিদের সুদিন ফেরাতে চাই। ইতোমধ্যে আমার তৈরি আচার আমেরিকায় গিয়েছে। লোক মারফত। কিন্তু আমি চাই আমার পণ্য একদিন সরাসরি যাবে। দেশের প্রত্যেকটি জেলায় আমার প্রোডাক্ট পৌঁছে দেওয়াও অন্যতম পরিকল্পনা।’