দেশীয় পণ্যের সুরক্ষায় আমদানিতে বেশি করারোপ : এনবিআর চেয়ারম্যান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ‘ভারত ও মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি নির্ভরতা কমানো ও দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষায় আমদানি পণ্যতে বেশি করারোপ করা হবে।’
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম চেম্বার মিলনায়তনে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান এ মন্তব্য করেন।
চিটাগং চেম্বার সভাপতি মাহাবুল আলম, পরিচালক আকতার হোসেন, মাহাফুজুল হক শাহ, আলতাফ হোসেন বাচ্ছুসহ বিভিন্ন চেম্বারের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নেন।
সুন্দর একটা বাংলাদেশের ও সরকারের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব লাগবে উল্লেখ করে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘যাদের সক্ষমতা আছে তাদের থেকে কর নেওয়া হয়। ভবিষ্যতে করারোপ সহজ ও স্বচ্ছতা আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। স্বনির্ভরতা অর্জনে রাজস্ব আহরণই মূল লক্ষ্য। জাতীয় বাজেট প্রণয়নে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সমাজের পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই রাজস্ব নেওয়া হয়। যাদের সক্ষমতা আছে তারাই কর দেন এবং দেশের উন্নয়নে ও জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যাপক অবদান রাখেন।’
শুধু কর আদায় করাই সরকারের একমাত্র কাজ নয় উল্লেখ করে মুনিম বলেন, ‘স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ও রক্ষা, দেশীয় উৎপাদন, কৃষি, স্বনির্ভরতা অর্জন, পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই করারোপ করা হয়।’
একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়নে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছতার জায়গাটা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান এনবিআর চেয়ারম্যান।
কর ফাঁকি রোধে এনবিআর প্রবর্তিত অনলাইন ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) এপ্লিকেশন চালুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) ডিভিএস ছাড়া অডিট রিপোর্ট গ্রহণ করা হবে না বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান।
‘এক্ষেত্রে রাজস্ব প্রক্রিয়া অধিকতর সহজ হবে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণসহ হয়রানিমুক্ত কর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’-বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান
সভায় চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রাজস্ব উপযোগী বাজেট চাই।’
তিনি করমুক্ত আয় সীমা বৃদ্ধি, পাবলিকলি ও নন-পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির করের হার কমানো, সারচার্জের ক্ষেত্রে নিট পরিসম্পদের পরিমাণ তিন কোটি টাকার পরিবর্তে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত শূন্য করার প্রস্তাব করেন।
এছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চট্টগ্রামে হাইকোর্টের পৃথক বেঞ্চ স্থাপন, অর্থডক্স বা নিবিড় পরিদর্শন বাতিল করা, আয়কর অধ্যাদেশের ৫২ ধারায় স্থানীয় উৎপাদকদের অগ্রিম কর থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাধারণ নিয়মে কর নিরূপণ বা পৃথক ধারা প্রণয়ন, কর নিষ্পত্তি আপিলের ক্ষেত্রে গড়ে শতকরা ৫ ভাগ কর জমাদান, লোকাল এলসির ক্ষেত্রে শতকরা দুই ভাগ করারোপ প্রত্যাহার, মোট প্রাপ্তি তিন কোটি টাকা হলে শূন্য দশমিক ৫ ভাগ ন্যূনতম আয়করের বিধান রহিতকরণ, খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত অর্থ আইন-২০২০ সংশোধন, ইস্পাত শিল্পে অগ্রিম কর সমন্বয়, গাড়ির ট্যাক্স টোকেন নবায়নে দুই বছরের পরিবর্তে আগের মতো এক বছরের অগ্রিম কর আদায় করা, কোয়ার্টারলি ট্যাক্স পরিশোধে বিলম্ব হলে জরিমানা থেকে অব্যাহতি, কর অবকাশ খাত বর্ধিতকরণ, ভ্যাটের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা এবং সেক্টর অনুযায়ী বিভিন্ন হারে নির্ধারণ, এলপিজি খাতে খুচরা বিক্রয়ের ওপর আরোপিত শতকরা ৫ ভাগ মূসক বাদ দিয়ে পুনরায় ট্যারিফ মূল্য চালুকরণ, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার বিক্রিতে শতকরা ৫ ভাগ মূসক প্রত্যাহার, জিপসাম বোর্ডের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার হ্রাস, কোটেড রডস, কোর্ড ওয়্যার, বেইজ মেটালের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করে স্থানীয় শিল্পে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম।
অন্য বক্তারা চট্টগ্রাম কাস্টমসের জনবল বৃদ্ধি, ল্যাবরেটরির পরীক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি, সব শুল্ক স্টেশনে অভিন্ন শুল্কহার প্রচলন, বছরের বিভিন্ন সময় না করে নির্দিষ্ট সময় ও ডেস্কে অডিট করা, বন্দরে অপেক্ষমান সাত হাজার কন্টেইনার দ্রুত নিলাম করা, রপ্তানি পণ্যের জন্য স্ক্যানার সংখ্যা বৃদ্ধি করা, ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম কর শতকরা ৪ ভাগ থেকে হ্রাস করে এক ভাগ করা, দেশীয় লবণ শিল্প রক্ষায় সোডিয়াম জাতীয় পণ্য আমদানিতে নজরদারি বৃদ্ধি করা, আয়োডিনের ট্যাক্স শতকার ৩০ ভাগ থেকে কমিয়ে ১০ ভাগ করা, শুটকি তৈরির মেশিন আমদানি শুল্কমুক্ত করা, গভীর সমুদ্র বন্দরে সিঅ্যান্ডএফ নিয়োগে স্থানীয়দের জন্য কোটা নির্ধারণ, ই-কমার্স আগামী ২/৩ করমুক্ত রাখা, নারী উদ্যোক্তাদের কর ব্যবস্থা সহজ ও নমনীয় করা, ফ্ল্যাট পুনরায় বিক্রির ক্ষেত্রে করহার কমানো, মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করে শতকরা পাঁচ ভাগ সুদে আবাসনে ঋণ দেওয়া, আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ অব্যাহত রাখা, প্রত্যেক কোম্পানিকে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের আওতায় ফাইন্যান্সিয়াল ডিসক্লোজার দিতে বাধ্য করা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকট নিয়ন্ত্রণে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ, নীতিমালা গ্রহণ ও করারোপের ক্ষেত্রে সাম্যতা নিশ্চিত করা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় ভ্যাট চালানের মাধ্যমে আসবাবপত্র বাজারজাতের সুযোগ দেওয়া, প্রশাসনিক দুর্বলতা দূরীকরণ, উপজেলা পর্যায়ে সক্ষম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপ করা, আরএমজি রপ্তানিতে শতকরা এক ভাগ প্রণোদনায় দীর্ঘসূত্রিতা দূরীকরণ, মালবাহী পরিবহনের টায়ার আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করা, শিপব্রেকিংয়ে বিভিন্ন পণ্যের ওপরে পৃথক কর প্রত্যাহার, ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত লুব অয়েলের পৃথক শুল্ক ঘোষণা, আমদানির আগে সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে জটিলতা দূরীকরণ ইত্যাদি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
এ সময় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন, সৈয়দ গোলাম কিবরীয়া ও মো. মাসুদ সাদিক, চট্টগ্রামের বিভিন্ন কর অঞ্চলের কমিশনার সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ, এম এম ফজলুল হক, গোলাম মো. মুনীর, মো. মাহবুবুজ্জামান, মো. হেলাল উদ্দিন সিকদার, এ কে এম হাসানুজ্জামান, মোহাম্মদ ফখরুল আলম, এ কে এম মাহবুবুর রহমান, মো. আকবর হোসেন, চেম্বার পরিচালক মো. অহীদ সিরাজ চৌধুরী (স্বপন), ছৈয়দ ছগীর আহমদ ও অঞ্জন শেখর দাশ উপস্থিত ছিলেন।