লাখপতির গল্প
প্রতিটি কাজকে মূল্যায়ন করলে বেকারত্ব থাকবে না : ফাতেমা জাহান
করোনার কারণে বেকার হয়ে পড়েছিল অনেক পরিবার। আবার এই করোনা অনেকের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। বাড়ে অনলাইনে কেনাকাটা। নিজ জেলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য কিংবা সহজলভ্য পণ্য অনলাইনে বিক্রি করে অনেকে বনে গেছেন লাখপতি।
তেমনই একজন গৃহিণী ফাতেমা জাহান। ছিলেন শিক্ষক। বিয়ের পর ছেড়ে দিতে হয় চাকরি। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে নিলেন উদ্যোগ, নাম মুন’স ক্লোসেট। যেখানে ব্লক, টাই-ডাই, স্ক্রিন প্রিন্ট, হোম ডেকর থেকে শুরু করে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি সবকিছুই পাওয়া যায়। ব্যস। এখন তিনি লাখপতি।
অদম্য সাহস ও কঠোর পরিশ্রম করে আজ সফল উদ্যোক্তা ফাতেমা জাহান। তবে এই চলার পথ খুব মসৃণ ছিল না। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে নিজের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন এ উদ্যোক্তা।
ফাতেমা জাহান জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মুন’স ক্লোসেট চালু করেন। সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। ভালো সাড়া পাচ্ছেন। কারণ হিসেবে বলেন, ‘দেশীয় পণ্য আমরা সবাই পছন্দ করি। আমার মূল প্রডাক্ট হলো ব্লক, টাই-ডাই ও স্ক্রিন প্রিন্ট। হোম ডেকর থেকে শুরু করে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি—সবকিছুই করি।’
ফাতেমা হ্যান্ডউড ব্লকের বিভিন্ন প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করেন। শাড়ি, থ্রি-পিস, ব্লকের হিজাব, পাঞ্জাবি, বেবি ড্রেস, বেডশিট, পর্দা থেকে শুরু করে ঘরের আনুষঙ্গিক জিনিসও আছে মুন’স ক্লোসেটে।
উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রশংসায় পঞ্চমুখ ফাতেমা জাহান। তিনি বলেন, ‘উই নিয়ে বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের স্বপ্ন পূরণের কারিগর হলো উই। আমাদের মতো গৃহিণীদের ঘরে থেকে কিছু করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করিয়েছে। আমাদের কাজ করার পথ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। দেশি প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করাটা খুব চ্যালেঞ্জের। এ রকম প্ল্যাটফর্ম আমাদের দেশি উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক দরকার। ধন্যবাদ নাসিমা আক্তার নিশা আপুকে, এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ রাজিব আহমেদ স্যারকে, যিনি আমাদের প্রত্যেক উদ্যোক্তার পরামর্শদাতা হিসেবে পথ দেখিয়েছেন। আমি সত্যিই তাঁদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। উই এখন অনেক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য, যাঁরা ঘরে বসেই অনেক কিছু শিখতে পারছেন।’
উদ্যোক্তা হয়ে কেমন লাগছে বা অনুপ্রেরণা কারা ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফাতেমা জাহান বলেন, ‘নিজের একটা পরিচয় কে না চায়। মাস্টার্স কমপ্লিট করে ইংরেজি বিষয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করতাম একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিয়ের পর ছেড়ে দেওয়াতে নিজের কাজটাকে খুব মিস করতাম। তাই এই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলা। আমার অনুপ্রেরণা হলো পরিবার। পরিবারের সহযোগিতা মোটামুটি পাচ্ছি। পজিটিভ-নেগেটিভ সবকিছুতেই থাকে। সবার মত এক হবে না। এটাই স্বাভাবিক।’
উই-এর ফেসবুক গ্রুপ উদ্যোক্তা-জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? ফাতেমার সাবলীল উত্তর, ‘এক কথায় উই না থাকলে হয়তো এত অল্প সময়ে এত দূর আসতে পারতাম না। কারণ, প্যান্ডামিক সিচুয়েশনে অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সে সময়টাতে আমাদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছে উই। এখন পর্যন্ত উই-এর একজন সদস্য হিসেবে আছি এবং থাকব। যখন বিজনেস শুরু করি, ভাবিনি, আমার প্রডাক্ট নিয়ে এতটা আস্থা অর্জন করাতে পারব। কিন্তু উই-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল : Tell your story, sell your product. আপনার প্রডাক্ট সম্পর্কে আপনি সবাইকে জানান, ক্রেতা আস্থার সাথে কিনবে। শুধু এটার জন্যই আমি এত দূর আসতে পেরেছি। বিভিন্ন ট্রেনিং, মাস্টার ক্লাস, ওয়ার্কশপ দিয়ে আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেক সাহায্য করছে উই।’
উদ্যোক্তা হওয়ার পর অনেক মধুর স্মৃতি আছে ফাতেমা জাহানের। বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার পর প্রথম সেলটা ছিল খুব আনন্দের। মধুর স্মৃতি হলো নিশা আপু আর রাজিব স্যারের সান্নিধ্যে আসা। মনে করার মতো স্মৃতি হলো, লকডাউনে কাস্টমারের পণ্য ডেলিভারি দেওয়াটা। খুব রিস্ক নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। আমার উদ্যোক্তা-জীবনের পেছনে আমার মা, বোন, স্বামী, শাশুড়ি সবারই ভূমিকাই আছে। সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দেয় আমার পাঁচ বছরের ছেলেটা। অনেক হেল্প করে প্যাকিং আর প্রডাক্ট ফটোগ্রাফি করার সময়। তা ছাড়া আমার নিজস্ব কর্মচারী আছে। তারা খুব দক্ষ। নিজস্ব ডেলিভারিম্যানও আছে। তাদের ছাড়া ঘরে থেকে সংসার সামলিয়ে ব্যবসা করা এতটা সহজ হতো না।’
উই-এ অনেকেই লাখপতি? আপনি কি হতে পেরেছেন? উত্তরে ফাতেমা জাহান বলেন, ‘জি, আলহামদুলিল্লাহ। আমি উই-তে লাখপতি হয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার উই-তে মোট সেল তিন লাখ টাকা। মার্চে জয়েন করেছিলাম উই-তে আর সেল শুরু হয় জুলাই থেকে। আলহামদুলিল্লাহ, এই বছরে অনেক প্রাপ্তি। ইনশা আল্লাহ, সামনে আরও এগিয়ে যাব। সবার জন্য একটাই কথা, অনলাইন বিজনেসে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং করাটা খুব জরুরি। যার পারসোনাল ব্র্যান্ডিং খুব ভালো, পরিচিতি খুব ভালো, সে ততই তার বিজনেস প্রসার করতে পারবে।’
বেকার সমস্যা সমাধানেও পরামর্শ দিয়েছেন ফাতেমা জাহান। তিনি বলেন, ‘বেকারত্ব আমাদের নিজেদের সৃষ্টি বলে আমি মনে করি। কারণ, একজন মানুষ চাইলে যেকোনো কাজ করতে পারে। শুধু যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, তা কিন্তু না। প্রতিটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তা কিছু না কিছু প্রতিভা দিয়েছেন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এখন যুগ পাল্টাচ্ছে। প্রতিটি কাজকে মূল্যায়ন করলে বেকারত্ব থাকবে না। উই-তে এমন হাজারও উদাহরণ আছে শিক্ষা নেওয়ার মতো।’
কঠোর পরিশ্রম আর মনোবলের মাধ্যমে নিজ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাবেন নারীরা, এ প্রত্যাশা সফল উদ্যোক্তা ফাতেমা জাহানের।