লাখপতির গল্প
৫০০ টাকায় ব্যবসা শুরু করে লাখপতি রায়হানা
ঔষধি গুণসম্পন্ন মাশরুমের চাহিদা বাড়ছে ব্যাপক হারে। অথচ এখনো চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম। উৎপাদন বাড়ানো গেলে অর্থনৈতিক সাফল্য নিশ্চিত। আর কারো সফলতা আসুক না আসুক, উদ্যোক্তা রায়হানা আক্তারের এসেছে। প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে? উত্তর যদি এভাবে হয়, মাত্র নয় মাসে মাশরুমের বিভিন্ন আচার, ডায়াবেটিস আচার ও কোলেস্টেরল আচার নামে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি করে ‘মাশরুম কথন’-এর রায়হানা বনে গেছেন লাখপতি।
কীভাবে এই উদ্যোগের ভাবনা মাথায় এলো, এ কাজ করতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, ভবিষ্যতের স্বপ্নই বা কী, এমন নানা বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেছেন রায়হানা আক্তার।
শুরুতেই জানতে চাওয়া, কেমন আছেন? কী নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন? চোখে যেন আলোর ঝলক, রায়হানা আক্তার বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে এবং বাবা-মায়ের দোয়ায় আমি ভালো আছি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত আমার জীবন। মাশরুম কথন আমার স্বপ্নের নাম, যা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে উই-এর কল্যাণে। আমার স্বপ্ন, একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের খাদ্যতালিকায় মাশরুম রাখা হবে। ’
কেমন সাড়া পাচ্ছে রায়হানার প্রতিষ্ঠান? বললেন, মাশরুমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ২০০৯ সাল থেকে। তখন তিনি সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন। হাতে অনেক অবসর। ভাবলেন, মাশরুম নিয়ে কিছু একটা করি। যেই ভাবা সেই কাজ। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সাভারে ট্রেনিংয়ের জন্য। তাঁর বাবা প্রতিদিন সকালে নিয়ে যেতেন। সারা দিন বাইরে বসে থাকতেন। আবার বিকেল ৪টায় তাঁর ছুটি হলে নিয়ে আসতেন। এত কষ্ট করেছেন শুধু রায়হানার জন্য। তিনি একটা কিছু করতে চান, এটা জেনে বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন।
এরপর শোনালেন দীর্ঘ গল্প। বললেন, ‘২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কলেজ ছুটির পর, কোচিং শেষে, এমনকি শুক্রবারও আমি কখনো ঘুরতে যাইনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিইনি। আমার সমবয়সীরা যখন পার্ক কিংবা ফোনের ওপারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেম করত, তখন আমি হাঁটতাম পথে-পথে, অলিগলির দোকানে-দোকানে। বোঝানোর চেষ্টা করতাম, এটি একটি হালাল ও পুষ্টিগুণে ভরপুর সুন্নতি খাবার। আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর প্রিয় খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এই মাশরুম। একে মান্না ওয়া সালওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। গরিবের ঘরে মাংস খাওয়ার তৃপ্তি মেটানোর এক আশ্চর্য সবজি। এটিকে সবজি বলা হলেও এর স্বাদ ও গুণাগুণ মাংসের মতোই। আমার পরিবারের কাউকে বুঝতে দিইনি আমি কত কত মাইল পথ হেঁটেছি। একটা মেয়ে হয়ে এভাবে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো যে কতটা কষ্ট, সেটা আমি তখন প্রতিটি ক্ষণে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি শক্ত ছিলাম, মনোবল শক্ত ছিল। ছিল নিজের প্রতি বিশ্বাস ও আল্লাহর ওপর ভরসা।’
রায়হানা বলে চললেন, ‘বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হয়েও মার্কেটিং করতে নেমেছিলাম নিজের পণ্য নিয়ে। দিন, মাস, বছর পর আলহামদুলিল্লাহ ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। কলেজে যাওয়া, পড়াশোনা; সবকিছু করেই আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। আমার নানু অসুস্থ হয়ে গেলেন এবং উনার পরিচর্যার বেশির ভাগ দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। নানুর পরিচর্যা এবং নিজের উদ্যোগ, এ দুটির মধ্যে আমাকে একটি বেছে নিতে হয়েছিল। আমি আমার নানুকে বেছে নিয়েছিলাম। কারণ, আমার উদ্যোগ আল্লাহ চাইলে আবার শুরু করতে পারব। কিন্তু নানু তো আমার সবচেয়ে আদরের। উনাকে সেবা করার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, এটা কীভাবে মিস করি আমি?’
সে সময় নিজের মনকে বোঝাতে রায়হানার অনেক কষ্ট হয়েছে, তবুও সব মেনে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজের স্বপ্নটা আর ধরে রাখতে পারেননি। রায়হানার সাবলীল ভাষ্য, ‘কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত আমি মাশরুম নিয়ে ভাবতাম। যদি আবার বিধাতা সুযোগ করে দেন, সেই আশায় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি মাশরুমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে। আমার পরিচিত একজন বড় ভাই সব সময় আমাকে সাপোর্ট করেছেন। উনার সঙ্গে জাতীয় সবজি মেলা ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭-তেও যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু নতুন করে আবার শুরু করার জন্য যে সাহস ও মূলধন প্রয়োজন, তা আমার কাছে পর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু আমি আশা হারাইনি। আমার লক্ষ্য স্থির ছিল। আমি বিশ্বাস রেখেছি, আল্লাহ অবশ্যই এমন একটি সুযোগ আমাকে দেবেন, যখন আমি আবার আমার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব।’
রায়হানার মাশরুম-প্রেমের গল্প আরো আগের। বললেন, ‘যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই টিউশন করতাম। সেই টাকা জমিয়ে মাশরুমের স্পন প্যাকেট কিনে উদ্যোগ শুরু করেছিলাম। আমি কখনো বাবা-মায়ের ওপর বোঝা হতে চাইনি। কারণ, আমার ছোট আরো দুজন ভাইবোন আছে। তাদের কথাও আমার মাথায় রাখতে হতো।’
কীভাবে নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম উই-এ জড়িয়ে পড়লেন, সে গল্পও বেশ বড়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে রায়হানার বন্ধু তাজিয়া ইসলাম নিরা তাঁকে উই গ্রুপে জয়েন করিয়ে দেন। কিন্তু তখন তাঁর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল বলে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু উই-এর উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পোস্ট পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে জড়িয়ে যান উই-এর সঙ্গে। পরে সক্রিয় হন আর ভাবতে থাকেন, ‘আমি কীভাবে সবার মতো একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে পারি?’
সেই গল্পটা এমন, ‘এখানে এসে বুঝতে পারলাম, উদ্যোগ শুরু করতে মূলধনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান, অভ্যাস ও দৃঢ়তা। এসব যদি পুঁজি হিসেবে অর্জন করা যায়, তাহলে যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় সহজে। উদ্যোগটি পরিচালনা করতে ও বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট বুঝতে ও শিখতে সাহায্য করেছে ডিএসবি নামের আরেকটি গ্রুপ, যা আমাদের রাজিব স্যারের নিজ হাতে গড়া একটি স্কিল ডেভেলপ করার গ্রুপ। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়া। কিন্তু বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এইচএসসির ফল আশানুরূপ না হওয়ায় সেই স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। শুরু থেকেই আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার মা, আর আমার কাঁধে সহযোগিতার হাত ছিল বাবার। আমার জীবনে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকলেও হতাশা আমাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। কিন্তু উই-তে অ্যাকটিভ হওয়ার পর আমাদের মেন্টর উই-এর উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যারের দিকনির্দেশনায় এবং উই-এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপুর সঙ্গ পেয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলাম। ভেঙে পড়া, ব্যর্থ জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের প্রাণের উই।’
রায়হানা আরো বলেন, ‘উই-এর সাপোর্ট ও গাইডলাইন পেয়ে আমি মাত্র ৫০০ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে আজ এক লাখ ৮০ হাজার টাকার সেল সম্পূর্ণ করে নিজেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ভাবছি। উই-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ছিল বলেই মাত্র ৫০০ টাকায় ব্যবসা করে লাখপতি হওয়া সম্ভব হয়েছে।’
রায়হানার অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর মা। একসময় তাঁর মা-ও উদ্যোক্তা ছিলেন। মায়ের গরুর ফার্ম ছিল। সেই থেকে রায়হানার স্বপ্ন উদ্যোক্তা হওয়ার। আর তাঁর বাবা সাপোর্ট দিয়েছেন বলেই উদ্যোগটি নিয়ে কাজ করা সহজ হয়েছে। এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন রায়হানা।
মাশরুমের উপকারিতার কথা শোনালেন রায়হানা আক্তার। তবে তাঁর তৈরি মাশরুমের আচারের বিশেষত্ব কী। বললেন, ‘মাশরুম দিয়ে আমি আচার তৈরি করছি, যা ছোট-বড় সবার পছন্দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এরই মধ্যে। আচারের মধ্যে আমি ডায়াবেটিস আচার ও কোলেস্টেরল আচার নামে দুটি ভিন্ন আচার অন্তর্ভুক্ত করেছি। ডায়াবেটিস আচারের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি তৈরি করছি চিনির বিকল্প সুক্রালোজ দিয়ে, যা খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের কোনো সমস্যা হবে না, আবার মাশরুম খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর কোলেস্টেরল আচারের বিশেষত্ব হলো, মাশরুমের সঙ্গে ৮০ শতাংশ রসুন ব্যবহার করে আচারটি প্রস্তুত করে থাকি। আমরা সবাই জানি, রসুন কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে আর মাশরুম কোলেস্টেরলের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও দূরীকরণে ভূমিকা রাখে।’
রায়হানার এখন অনেক অর্ডার। নিজস্ব ফার্ম দিতে পেরেছেন এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম নিয়ে কাজ করতে পারছেন। তো, মান কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন? রায়হানা আক্তার বলেন, ‘মাশরুমের বীজ, যেটিকে স্পন প্যাকেট বলা হয়, সেটি প্রস্তুত করার সময় শতভাগ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অটোক্লেভ মেশিনে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত বীজ উৎপন্ন করে থাকি। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন এবং স্বাস্থ্যসম্মত মাশরুম উৎপাদন হচ্ছে। মাশরুমের হার্ভেস্ট থেকে প্যাকেজিং পর্যন্ত আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রেখে প্যাকেটজাত করছি এবং সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করছি, যেন মাশরুমের গুণাগুণ সর্বদা অটুট থাকে।’
মাশরুম নিয়ে কত স্বপ্ন রায়হানার। তাঁর আশা, পুষ্টিকর ও গুণগত মানসম্পন্ন এবং স্বল্পমূল্যের মাশরুম যেন দেশের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব মানুষ সহজে ও নিয়মিত গ্রহণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। এর চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি করা। যেন অন্তত নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়।
রায়হানা আক্তার সুশিক্ষিত। উদ্ভিদবিজ্ঞানে বিএসসি করেছেন। বর্তমানে এমএসসি পরীক্ষার্থী। এই উদ্যোগের পাশাপাশি তিনি কম্পিউটার প্রফেশনাল কোর্স ও গ্রাফিকস ডিজাইনের ওপর দক্ষতা অর্জন করেছেন।
উদ্যোক্তাদের জন্য রায়হানার পরামর্শ, যেকোনো উদ্যোক্তাকে তাঁর উদ্যোগ নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে। ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন আইটি সাইটে পড়াশোনা করে নিজেদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং নিজের ভিত তৈরি করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর ধৈর্য ধারণ তো করতেই হবে। তাহলে সাফল্য নিশ্চিত।