তরুণ উদ্যোক্তা
একটি ব্যর্থতাই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়
কোনো উদ্যোগ সফল হবেই এমন আশা করাটা বোকামি। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। আর একটি ব্যর্থতাই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং তা পরবর্তী উদ্যোগের সফলতার পাথেয়।
কায়সার হামিদের শুরুটা হয়েছিল ব্যর্থতা দিয়েই। তৈরি পোশাক নিয়ে ব্যবসার গভীর আগ্রহ থেকে ছাত্রজীবনেই ব্যবসার উদ্যোগ নেন। অনভিজ্ঞতাসহ নানা কারণে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হয় তাঁর। এমন ব্যর্থতায় উদ্যম হারাননি। আবার পুঁজি জোগাড় করেছেন। আগের উদ্যোগের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে অবশেষে দাঁড়িয়ে গেছে তাঁর নতুন উদ্যোগ। নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউস নামের প্রতিষ্ঠানকে লাভের পর্যায়ে এনে স্বীকৃতি পেয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা কায়সার হামিদ।
কায়সার হামিদের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পের শুরুটা বেশি পুরোনো নয়। গ্রাম থেকেই এসএসসি সম্পন্ন করে ঢাকায় এসে কারিগরিতে ভর্তি হন তিনি। ২০০৫ সালে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বস্ত্র প্রকৌশলে পড়াশোনা শুরু করেন। স্নাতক সম্পন্ন যুবকদের চাকরির জন্য হাহাকার দেখে বুঝলেন, এমন পথ তাঁর জন্য নয়। পণ করলেন, যে করেই হোক উদ্যোক্তা হবেন। স্বপ্ন দেখেন, নিজেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলবেন। প্রতিষ্ঠিত করবেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ব্র্যান্ড।
পড়াশোনার বিষয় যেহেতু বস্ত্র প্রকৌশল, তাই তৈরি পোশাকশিল্পকেই নিজের উদ্যোগের জন্য বেছে নিলেন। পড়াশোনা অবস্থায়ই পরিবার থেকে কিছু টানা নিয়ে ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার-দেনা করে শুরু করলেন তৈরি পোশাকের উদ্যোগ। তবে অনভিজ্ঞতাসহ নানা কারণে বেশিদূর আগাতে পারেনি ওই উদ্যোগ। ফলাফল কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি। পরিবারের চাপ আর ঋণের বোঝায় দিশে হারাননি কায়সার। ছাত্র অবস্থায়ই ঋণের টাকা ধীরে ধীরে শোধ করা শুরু করেন। পরে চাকরি করে বাকি টাকা শোধ করেন এবং আবার ব্যবসার পুঁজি জোগান। একসময় পারিবারিক সূত্রেও কিছু টাকা পান। মোট সাড়ে তিন লাখ টাকা জমে।
আগের ব্যর্থতার শিক্ষা নিয়ে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে আবার তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোগ নেন কায়সার হামিদ। তবে এবার একা নয়, সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গিনী। যাত্রা শুরু করে নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউস। কায়সার হামিদের প্রথম অফিস এবং কারখানা হয় রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ায়। প্রাথমিক অবস্থায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে চারটি মেশিন, কাপড়, সুতা এবং আর কিছু জিনিসপত্র কেনেন। পরে কয়েক মাসে পুঁজি বাড়ে। একসময় বিনিয়োগ হয়ে ওঠে আট লাখের ওপরে। তবে পুঁজির বেশির ভাগই খরচ হয় যন্ত্রপাতির পেছনে।
নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউসের পথচলার শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। তরুণ উদ্যোক্তা কায়সার হামিদের প্রথম সমস্যা ছিল কর্মচারীদের বেতন অব্যাহত রাখা। প্রাথমিক অবস্থায় কাজের অভাবে তেমন আয় হচ্ছিল না। প্রতি মাসেই ৩০ হাজার টাকা করে লোকসান গুনতে হয়েছে। অনেকেই বাকিতে কাজ করাতে চাইত। এ ক্ষেত্রেও টাকা আটকে থাকে। তবু কাজ অব্যাহত রেখেছেন কায়সার হামিদ। সাত-আট মাসের মাথায় তাঁর প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখে। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠান লাভেই চলছে। প্রতি মাসেই কয়েক লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কর্মীদের বেতন দিয়েও মোটমুটি লাভ থাকছে কায়সারের।
তরুণ উদ্যোক্তা কায়সার হামিদের নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউস প্রতিষ্ঠানটি ছোট হলেও এর কার্যক্রম চলে বেশ সুষ্ঠুভাবে। তিনি নিজে ও স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের অনেক দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কায়সার দেখেন উৎপাদন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো, আর তথ্য ও হিসাব সংশ্লিষ্ট দেখাশোনা করেন তাঁর স্ত্রী। কয়েকজন কর্মীর প্রত্যেককে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। সে অনুযায়ীই সবকিছু চলছে। প্রতিটি কর্মীকেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। কখনো লক্ষ্যমাত্রার হেরফের হলে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বড় সমস্যা দেখা দিলে সবাই মিলেই করা হয় সমাধান।
নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউসের লক্ষ্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে কায়সার হামিদ বলেন, তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য দেশে ও বিদেশে তাঁর প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বাড়ানো। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁদের তৈরি পণ্য যাচ্ছে। মালয়েশিয়াও কিছু পণ্য পাঠানো হয়েছে। অনেক শোরুমে পাওয়া যাচ্ছে তাঁর পণ্য। আজকের ডিল, ইত্যাদি ই-শপসহ অনেক অনলাইন শপে মিলছে নিউ মুনের পোশাক। আর উদ্যোগকে লাভজনক ও বেশ কয়েকজন কর্মীকে চাকরি দেওয়ার সুবাদে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ গ্রুপের পক্ষ থেকে নবীন উদ্যোক্তা সম্মাননা-২০১৪ পেয়েছেন কায়সার হামিদ।
কায়সার হামিদের আশা তাঁর প্রতিষ্ঠান নিউ মুন ক্লদিং ডিজাইন হাউস একদিন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করবে। তবে এ জন্য এখনো বহুদূর পাড়ি দেওয়া বাকি। এই দূর পথপরিক্রমায় একা পেরে ওঠা দুরূহ। তাই সরকারি আর্থিক সহায়তা আশা করেন কায়সার হামিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোক্তা ঋণ পাওয়া গেলে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন কায়সার হামিদ।