জন্মদিন
প্রকৃতির প্রেমেই পঁচাশি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে বোটানিক্যাল উদ্যানের লাগোয়া গ্লিরিসিডিয়া গাছটির সঙ্গে পরিচয় ভোলার নয় দ্বিজেন শর্মার। ‘বসন্তের শুরুতেই নিষ্পত্র শাখাগুলোতে বেগুনির আঁচ মেশানো সাদা ফুলের ঢল নামত। একটি কোকিল গাছটিতে বসে সারা দিন অবিরাম ডাকত। দখিনা হাওয়ায় একটি-দুটি করে ফুল ঝরত। নেহাল হোসেন, বিপ্রদাশ বড়ুয়া আর আমি প্রতি সন্ধ্যায় ওই গাছতলায় আড্ডা বসাতাম। আবছা আলোয় ক্রমে কার্জন হলের মোগল স্থাপত্য রহস্যময় হয়ে উঠত। কিছুটা কল্পনাবিলাসও যে হতো না, তা নয়। সন্ধ্যার আবছা আলোয় আমরা ভাবতাম, গ্লিরিসিডিয়ার অদ্ভুত সুন্দর লতানো ফুলগুলো বেয়ে নেমে আসবে কোনো কল্পলোকের রাজকন্যা!’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামেন দ্বিজেন শর্মা।
একটু বিরতি দিয়ে দ্বিজেন আবার ফিরে যান তাঁর পুরোনো প্রিয় ঢাকায়, “কার্জন হলের কাছে সেগুনবাগিচা মোড়ের সড়কদ্বীপে পুরোনো বটগাছের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা বাগান-বিলাসের একটি লতা ম্যাজেন্টা রঙের ফুলের ধ্বজা উড়িয়ে শহরে বসন্তের আগমনী ঘোষণা করত। স্পেক্টাবিলিস জাতের ওই বাগান-বিলাসটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাবাসী বহু প্রজন্মের জীবনের সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই তো আমাদের জানাত, ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’।”
‘সাতাত্তরের বৃক্ষনিধনে বেইলি রোডে নাগলিঙ্গম, মহাখালী থেকে এয়ারপোর্ট রোডের কৃষ্ণচূড়াগাছ, রমনা পার্কের লাগোয়া সেগুনবীথি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশের সড়কদ্বীপের বট-অশ্বত্থ, নিউমার্কেটের পাশের বটগাছের সারির সঙ্গে আমাদের যৌবন দিনের স্মরণিক ওই বাগান-বিলাসটিও নিহত হয়,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন দ্বিজেন শর্মা।
গাছের প্রাণের সঙ্গে নিজের প্রাণের অস্তিত্ব যিনি অনুভব করেন, তাঁর পক্ষেই নিজের সন্তানের মতো বৃক্ষকে আপন করে নেওয়া সম্ভব। আর দ্বিজেন শর্মা তাঁর জীবনভর সেই কাজটিই করেছেন। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এই উদ্ভিদবিদ তাঁর নিসর্গ প্রেমকে ধারণ করেছেন নিজস্ব পরিমণ্ডলে। গাছের সঙ্গে কথা বলে আর তাদের সঙ্গে ভালোবাসা আদান-প্রদানের মাঝে কবে যে কেটে গেছে জীবনের ৮৫ বছর, টের পাওয়ার সময়টাই পাননি তিনি।
১৯২৯ সালের আজকের দিনে (২৯ মে) সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্ম দ্বিজেন শর্মার। বাবা গ্রাম্যচিকিৎসক, গ্রাম্য ভাষায় ‘কবিরাজ’ ছিলেন বলে নিজের বাড়িতেই দেখেছেন নানা লতাপাতা আর বৃক্ষের সমাহার। কবিরাজ বাড়ির বাগানেই অজস্র গাছগাছালি ছিল, তার মাঝে ছিল স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, মধুমালতীসহ নানা রঙ-বেরঙের ফুল। বসন্ত শেষের বৃষ্টির পর সারা বাড়ি যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠত, দ্বিজেন শর্মা তখন সকালে পূজার ফুল তুলতেন। সে সময়ই মনের অজান্তে দ্বিজেন শর্মাও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন।
দ্বিজেন শর্মার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকালেই দেখা যেত, নিকড়ি নদী, মৌলভী সাহেবের মাজার, সুবিস্তৃত ধানখেত, দূর দিগন্তে খাসিয়া পাহাড়ের নীলাভ ঢেউ। মাজারের কাছেই ছিল কয়েকটি জারুলগাছ। প্রতি গ্রীষ্মে গাছগুলো বেগুনি রঙের ফুলে আচ্ছন্ন হতো, রঙিন মিনারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ওই গাছগুলোর ঝরে পড়া ফুলে ঘাসগুলো ঢেকে যেত। শৈশবের প্রজাপতি ডানামেলা দিনগুলোতে পাথারিয়া পাহাড়ের আরণ্যক নিসর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আর সেখান থেকেই গাছপালার প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসা জন্মে।
দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখক-জীবনের বর্ণাঢ্য কিছু সময় কাটিয়েছেন মস্কোয়। সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরির সুবাদে চষে বেড়িয়েছেন গোটা ইউরোপ। এসব অভিজ্ঞতার কথামালা সাজিয়েছেন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’, ‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে’, ‘চেলসি পুষ্প মেলায়’, ‘বসন্ত জাগ্রত : লন্ডন’, ‘আলমদের দেওদারগাছ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ-গ্রন্থে। এ সবকিছুর সঙ্গে দেশের উপমাও খুঁজেছেন, মতামত দিয়েছেন, অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন অনেক জটিল তত্ত্ব-তথ্য। ভিনদেশি নিসর্গশোভা ও উদ্যান বিষয়ে এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশে ফিরে এসেছেন, আমাদের হারিয়ে যাওয়া উদ্যান-ঐতিহ্যের কথা বলেছেন, খুঁজেছেন আলোচিত বাগানের ইতিহাস ও অন্য অনুষঙ্গ।
দেশে ফেরার পর কাজ করেছেন বিভিন্ন উদ্যান আর বন সংরক্ষণেও। রমনা পার্কে তমাল, কাউয়াতুতি (পারুল বলে পরিচিত), মাকরিসাল, ডুলিচাঁপা, কনকচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া, ধারমারা আর পবনঝাউ—এসব দুর্লভ বৃক্ষের প্রজাতি সংরক্ষণ করেছেন নিজ উদ্যোগে। এ জন্য মিলেছে স্বীকৃতিও। লেখনীর জন্য ১৯৮৭ সালে পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ২০১১ সালে ভূষিত হন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আইয়ের ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রকৃতি সংরক্ষণ পদকে। আর চলতি বছর ভূষিত হন একুশে পদকে।
নিভৃতপ্রিয়, প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গপ্রেমী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ দ্বিজেন শর্মা সেই প্রজন্মের মানুষ, যাঁরা এই উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু এসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা থাকলেও তাঁর মধ্যে ছিল শিল্পবোধ আর দেখার চোখ—সুন্দরকে অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা। মানবজাতির জন্য তাঁর মনে সব সময় এক অনিঃশেষ আশাবাদ ও শুভকামনা কাজ করে। আর লেখালেখির মধ্যেই তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে বারবার।