অস্টিও আরথ্রাইটিস কী
সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অস্টিও আরথ্রাইটিস রোগটি হয়। তবে জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। আজ ৩ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৫৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম মতিউর রহমান ভূঁইয়া।
প্রশ্ন: অস্টিও আরথ্রাইটিস বিষয়টি কী?
উত্তর: অস্টিও আরথ্রাইটিস হলো বয়স্কদের বাত। সাধারণত মনে করা হয়, ৪৫ বছর থেকে এর ওপরের যে জনগোষ্ঠী আছে, তাঁদের জয়েন্টে সামান্য পরিবর্তন হয়, বয়সজনিত পরিবর্তন । একে অস্টিও আরথ্রাইটিস বলে। অনেকে একে অস্টিও আরথ্রাইসিস বলতে পছন্দ করেন। কারণ এটা ট্রু ফর্ম অব আরথ্রাইটিস না। এটা সিডো আরথ্রাইটিস। কাজেই অস্টিও আরথ্রোসিস সবচেয়ে সুন্দর নাম। তবুও সাধারণভাবে এটাকে অস্টিও আরথ্রাইটিস বলে। যেহেতু জয়েন্ট সামান্য একটু ফুলে যায়, জয়েন্টে ব্যথা হয়। আর জয়েন্টের কার্যকারিতাও কিছুটা হ্রাস পায়। তবে লক্ষণগুলো আরথ্রাইটিসের কাছাকাছি। সে জন্য আমরা নকল আরথ্রাইটিস বলতে পারি। এর মূল কারণের মধ্যে একটি থাকে জেনেটিক। যা ব্যক্তির বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন পরিবারের লোকদের থাকে, এর ফলে হয়।
আর পরিবেশগত কারণের মধ্যে আঘাত, হরমোনাল স্ট্যাটাস এবং নারী না কি পুরুষ এসবের ওপর রোগ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। ধূমপানও খুব বড় একটি কারণ।urgentPhoto
প্রশ্ন : একজন মানুষ অস্টিও আরথ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে তার বেলায় কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে? ওই ব্যক্তির কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : সাধারণত এসব রোগী জয়েন্ট ব্যথা নিয়ে আসেন। বড় বড় জয়েন্টে হয়। সাধারণত হাঁটুর জয়েন্ট, পৃষ্ঠদেশের জয়েন্ট এবং ঘাড়ের জয়েন্টে সমস্যা নিয়ে আসেন। আর ঘাড়ের ব্যথায়, সার্ভাইকাল জয়েন্ট আর কোমরের জয়েন্ট যাকে আমরা লাম্বার স্পনডাইলোসিস বলি, এসব বড় বড় জয়েন্টে ব্যথা হয়। জয়েন্টগুলো সামান্য একটু ফুলে যায়, খুবই অল্প। জয়েন্টগুলোর কিছুটা কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। তবে সকাল বেলার আড়ষ্টতা যা রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসে হয়। এটা এখানে এত বেশি হয় না। রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসে এটি এক ঘণ্টা থাকে। এখানে ১৫ মিনিটের বেশি থাকে না।
সবচেয়ে বড় জিনিস হলো রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসে কাজকর্ম করলে রোগী ভালো থাকবে। আর এখানে কাজকর্ম করলে রোগীর ব্যথা বেড়ে যাবে। এখানে যদি কাজ করে, হাঁটা হাঁটি করে ব্যথা বেড়ে যাবে।
আর রিউমাটয়েড আরথ্রাটিসে কাজকর্ম করলে, হাঁটাহাঁটি করলে ব্যথা কমে যায়।
প্রশ্ন : এই রোগের জন্য কারা বেশি ঝুঁকিপ্রবণ? কাদের বেলায় বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
উত্তর : ঝুঁকির মধ্যে এক নম্বর হলো জেনেটিক বিষয়। সাধারণত এটা জন্মগতভাবেই পেয়ে থাকেন বাবা-মায়ের মাতার কাছ থেকে। আর যাঁরা বিভিন্ন মেকানিক্যাল কাজ বেশি করেন, যেমন, ড্রিল মেশিন চালান, কাঠ কাটেন, করাতের কাজ করেন, ভারী জিনিস তোলেন এই ধরনের কারণে জয়েন্টগুলো একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া যাঁরা খেলাধুলা করেন তাঁদেরও অন্যান্য মানুষের থেকে অস্টিও আরথ্রাইটিসের আশঙ্কা বেশি। এরপর নারীর ৪৫ বছর পর, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, মেনোপোজ হয়ে যাওয়ার পর, অস্টিও আরথ্রাইটিসের আশঙ্কা থাকে। পুরুষের চেয়ে নারীর অস্টিও আরথ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ধূমপান যাঁরা করেন, তাঁদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদেরও অস্টিও আরথ্রাইটিস হওয়ার প্রবণতা বেশি। আবার জন্মগত কতগুলো হাঁড়ের রোগ আছে ওগুলোর কারণেও অস্টিও আরথ্রাইটিস হতে পারে। এসব হাড়ের রোগের জন্য ১০ বছর বয়সেই এই রোগ কারো কারো ক্ষেত্রে হতে পারে।
সাধারণত অস্টিও আরথ্রাইটিস ৪৫ বছরের পরের রোগ। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চাদেরও এটি হতে পারে। সাধারণত আমরা ধরে নেব যে জন্মগত ত্রুটি এবং আঘাতজনিত ত্রুটি এই দুটোর সমস্বয়ে অস্টিও আরথ্রাইটিস হয়।
প্রশ্ন: একজন রোগী এ রোগে আক্রান্ত কি না এই লক্ষণগুলো জানার পরে নিশ্চিত করেন কীভাবে?
উত্তর : আমরা কিছু ল্যাবেরেটরি পরীক্ষা করি। সাধারণত দেখা যায়, রিউমাটয়েড আরথ্রাবইটিসে, ইএসআর, সিআরপি এগুলো বেড়ে যায়। এখানে এগুলো স্বাভাবিক থাকে। এ ছাড়া আরএ অফ্যাকটর, অ্যান্টি সিসিবি অন্যন্য অ্যান্টিবডি এগুলো সাধারণত স্বাভাবিক থাকে। আমরা যখন রেডিওলজির এক্সরে করি, দেখা যায় যে জয়েন্টের ফাঁকাগুলো সরু হয়ে যায়। কাঁটার মতো হাঁড়ের কোণগুলো বেড়ে যায়।
জয়েন্ট কিছুটা বিকৃত হয়ে যায়। কিছুটা ক্ষতি হয়ে যায়। এটা দেখে আমরা বুঝতে পারি অস্টিও আরথ্রাইটিস হয়ে গেছে। তখন চিকিৎসার কথা বলি।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হলো জীবনযাপনের ধরন পরবির্তন।
প্রশ্ন : জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো অস্টিও আরথ্রাইটিস হতে বা বাড়াতে ভূমিকা রাখে?
উত্তর : ব্যক্তির কাজ যদি ওজন তোলা, বা মেকানিক্যাল কঠিন কাজ হয়- এগুলো সাধারণত অস্টিও আরথ্রাইটিস হতে সাহায্য করে। প্রয়োজন হলে তাকে পেশা পরিবর্তন করতে হবে। তবে লেখাপড়া, সাধারণ ঘরের কাজ এসব করলে কোনো সমস্যা নেই। ম্যানুয়াল মেকালিক্যাল কাজ বা মানুষ দিয়ে যেসব মেকানিক্যাল কাজ করা হয়, এগুলোতে কিছু অসুবিধা আছে। ওজন কমানো, ধূমপান বন্ধ করতে হবে। এরপর হাড়ের ঘনত্ব যেন ঠিক থাকে এ জন্য ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি এগুলো ঠিকমতো খেতে হবে। যেসব জয়েন্ট আক্রান্ত হয় এসব জয়েন্টের জন্য ফিজিওথেরাপি, বিভিন্ন অকুপেশনাল থেরাপি আছে সেই সাহায্যকারী থেরাপিগুলো দিলে জয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে কর্মক্ষম হয়ে যায়। এবং ভালোর দিকে থাকে।
প্রশ্ন : যাঁদের ওজন বেশি তাঁদের যদি অস্টিও আরথ্রাইটিস হয়, তাঁদের চিকিৎসকরা বলেন ওজন কমাতে। কিন্তু তাঁদের একটি অভিযোগ হলো আমার তো হাঁটুতে ব্যথা, হাঁটতে পারি না, ওজন কমাব কীভাব?
উত্তর : হ্যাঁ এই অভিযোগ অনেকেই করেন। আস্তে আস্তে তাদের হাঁটানোর অভ্যাস করতে হবে। তাদের সেই জয়েন্টকে শক্ত করার জন্য কিছু ফিজিওথেরাপি আছে। এই সব থেরাপি দিয়ে জয়েন্টকে ধীরে ধীরে কর্মক্ষম করে এরপর ওনাকে হাঁটার জন্য বলতে হবে। পাশাপাশি খাবারের অভ্যাস বদলাতে হবে। ওজন কমানো খুব বড় একটি বিষয় এই রোগের ক্ষেত্রে। ধূমপান বন্ধ করা খুবই বড় জিনিস। এ দুটি অস্টিও আরথ্রাইটিসের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস।
প্রশ্ন : চিকিৎসার অংশ হিসেবে মেডিকেশনের দিকে কী করে থাকেন?
উত্তর: রোগীকে প্রথমে বোঝাতে হবে এটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। আমরা যদি পারি ব্যথার ওষুধ হয়তো তদববই না। হয়তো প্যারাসিটামল দেব। যদি এতে না ভালো হয় সামান্য একটু ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়। কোনো সময় জয়েন্ট যদি ফুলে যায়, জয়েন্টের মধ্যে যদি পানি জমে যায় , একটি ইনজেকশন দিয়ে পানি বের করে দিয়ে আস্তে আস্তে ফিজিওথেরাপি দিলে জয়েন্টটা ভালো হয়ে যায়। তাদের ব্যায়াম করতে বলতে হয়। পাশাপাশি ফলোআপে আসলে ধীরে ধীরে সমস্যাটি ভালো হয়ে যায়। বয়স তো আমরা কমাতে পারব না। ওনার কষ্টটা যেন কমাতে পারি সেই চেষ্টাই করা হয়। তাঁকে যেন কর্মক্ষম রাখা যায় যেই চেষ্টাই করা হয়।
প্রশ্ন : এ ধরনের রোগীদের তো ব্যথানাশক ওষুধ সারা জীবন ধরে খেতে হয়। আবার ব্যথানাশক ওষুধ খুব ক্ষতিকর এই ধারণাও অনেকের মধ্যে আছে। তাহলে আপনারা এ দুটির সমন্বয় করেন কীভাবে?
উত্তর : আমরা এখানে তীব্র ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করি না। সাধারণত প্যারাসিটামল ব্যবহার করি। এটা খুবই কম ক্ষতিকারক ওষুধ। এটা খাওয়া যায়। এমনকি কিডনির ক্ষতি করবে না এরকম ব্যথানাশক ওষুধও রয়েছে এগুলো আমরা ব্যবহার করি। তাছাড়া এখানে আমরা ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করি। বিভিন্ন ওয়েন্টমেন্ট পেস্ট হিসেবে পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করি। এমনকি ব্যথা নাশ করে, কিন্তু ওই গ্রুপের ওষুধ না, যেমন, গাভা পেন্টিন এগুলো দিয়েও আমরা অনেক সময় ব্যথা কমিয়ে দিতে পারি। রোগীর জন্য যেটি ক্ষতিকর হবে না সেই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়।