অবসর গ্রহণের পর জীবন কেমন হবে
পেশা আমাদের জীবনের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে। সারা জীবন ধরে আমরা কাজের মধ্যে থাকি। চাকরি করি, ব্যবসা করি বা কোনো না কোনোভাবে আয়-রোজগার করি। সময় কেটে যায়। বয়স বাড়ে। শক্তি কমে আসে। সময় আসে অবসর গ্রহণের। সব কিছু কেমন বদলে যায়!
বয়সকালের জটিল রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, আরথ্রাইটিস, হাড়ের ক্ষয় রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ডিমেনসিয়া ইত্যাদির সঙ্গে হতাশা ও উৎকণ্ঠা জড়িত থাকে। মানসিক সমস্যার ফলে রোগী শারীরিক রোগের চিকিৎসাবিধি ঠিকমতো মানতে পারে না। ফলে শারীরিক রোগের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। বিষণ্ণতা, উৎকণ্ঠা, মৃত্যুভীতি, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিস-অর্ডার, স্মৃতিভ্রংশ, সাইকোটিক রোগ (যেমন, সিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া) ইত্যাদি দেখা যায়। জীবনযাত্রার গুণগত মান অনেক কমে যায়। অনেক সময় তারা অবহেলার শিকার হন। অনেকের মধ্যে এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়।
অবসরগ্রহণকে সুন্দর সময়ে পরিণত করা যায়। এর জন্য অবসরপ্রাপ্তদের যেমন দায়িত্ব আছে,তেমনি সমাজের সবারই দায়িত্ব আছে। অবসর গ্রহণের পর মানসিক সমস্যা কমাতে যা ভাববেন বা যে কাজগুলো করতে পারেন :
১. অবসরজীবনকে পূর্ণতার সময় হিসেবে দেখুন। সারা জীবন আপনি যথেষ্ট করেছেন। এখন বিশ্রাম নেওয়া ও আনন্দে থাকা আপনার অধিকার।
২. নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। এগুলো মুখ দিয়ে উচ্চারণও করবেন না। আশাবাদী হন। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। হতাশা প্রশ্রয় দেবেন না।
৩. সমালোচনা এড়িয়ে চলুন। দুনিয়ার সবাইকে ঠিকপথে চালিত করার দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নেই। উচিত, অনুচিত, সৌজন্য শিক্ষা দেওয়াও একটা মাত্রার মধ্যে রাখা ভালো। যখন আপনি তরুণ, যখন আপনি মধ্যবয়সে আছেন, যখন আপনি ব্যক্তিগত ক্ষমতার শীর্ষে, তখনই এটা মনে রাখা দরকার সবচেয়ে বেশি। আপনার সন্তান, পুত্রবধূ, কাউকেই নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত কঠোর হবেন না। যখন সময় আপনার দিকে হেলে আছে, তখনই সময় কৌশলী হওয়ার, আবেগ দিয়ে চালিত না হয়ে জ্ঞান দিয়ে চলুন। ভালো ব্যবহার করুন, ক্ষমা করুন, সৌজন্য করুন, ছাড় দিন।
৪. অবসর গ্রহণের জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন। যাতে অর্থকষ্ট পড়তে না হয়, সে জন্য সঞ্চয় করুন। অবসরের সময় কীভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন তার একটি বাস্তব পরিকল্পনা করুন।
৫. নিজেকে বুড়ো ভাববেন না। বুড়ো ভাবলেই বুড়ো। না ভাবলে আপনার মন সতেজ থাকবে। শরীরও থাকবে ভালো।
৬. নিজের সামাজিক সম্পর্কগুলো ঝালাই করে নিন। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে অবসরের অনেকটা আগেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। সন্তানের সঙ্গে, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে নিন। কোনো সমস্যা থাকলে অবসরের বেশ আগেই মিটিয়ে ফেলুন। অবসরে এই নতুন মাত্রার সম্পর্কটি আপনার কাজে আসবে। নাতি-পুতি নিয়ে থাকুন। তাদের সঙ্গে খেলুন। গল্প করুন। তাদের স্কুল থেকে আনা-নেওয়ায় সাহায্য করুন। তাদের সহায় হোন। মনে রাখবেন গম্ভীর হয়ে থাকা, আতঙ্কের উৎস হয়ে ওঠা গর্বের বিষয় নয়।
৭. নিজের শিকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন। আপনার অজপাড়াগায়ের মানুষ, আপনার চিরচেনা আত্মীয়রা, ছোট্ট বেলার বন্ধুরা বার্ধক্যে আপনার বড় ধরনের বন্ধন হয়ে উঠতে পারে। তাদের কাছে যান। যাতে আপনার প্রয়োজনে তারাও আপনার সঙ্গে থাকে।
৮. জীবনের নতুন অর্থ দাঁড় করান।
৯. অবসরের সময়ে এমন কিছু করুন যে কাজ করে আপনি সত্যিই আনন্দ পান।
১০. মেডিটেশন করতে পারেন।
১১. স্বাস্থ্যবিধি মানুন। নিয়মিত হাঁটুন। দৈনিক আধা ঘণ্টা হাঁটলে সেটাও খারাপ নয়। হাঁটার জন্য একজন সঙ্গী-সঙ্গিনী জোগাড় করুন। হাঁটা সহজ হবে।
১২. মাত্রামতো সুষম খাবার খান।
১৩. রক্তচাপ, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
১৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
১৫. প্রয়োজনমতো চিকিৎসা নিন। নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করান। কোনো সমস্যা ধরা পড়লে সময়মতো চিকিৎসা শুরু করুন। ব্যথা-বেদনার জন্য প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি নিতে পারেন। বিষণ্ণতা ও উৎকণ্ঠার জন্য সাইকোথেরাপি নিতে পারেন।
১৬. ডাক্তারের পরামর্শমতো ক্ষতিকর খাবার এড়িয়ে যান। যেমন, যদি গ্যাস্ট্রিক থাকে তবে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে এমন খাবার খাবেন না (যেমন, ভাজাপোড়া বা বাসার বাইরের হোটেলের তৈলাক্ত খাবার)।
১৭. পর্যাপ্ত ঘুমান। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমাবেন না।
১৮. শখের কাজ করুন। যেমন : বাগান করুন, গাছ লাগান, বেড়ান ইত্যাদি।
১৯. সংসারের টুকিটাকি কাজে লাগুন। রান্নাবান্না করা, বাজার করা, বিল দেওয়া ইত্যাদি করুন।
২০. জীবনের সুস্থ রুটিন বজায় রাখুন। নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে উঠুন ও সময়মতো ঘুমাতে যান। নিয়মিত গোসল করুন, দাঁত মাজুন ও নখ কাটুন।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট