বৃদ্ধ বয়সে হৃদরোগের চিকিৎসা
বৃদ্ধ বয়সে হৃদরোগের চিকিৎসা করা একটু জটিল হয়ে পড়ে। কেননা, এ সময় শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই জটিলতা তৈরি হয়। তবে আশার বিষয় হলো, প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে কিছু উন্নত চিকিৎসা রয়েছে, যেগুলো বৃদ্ধ বয়সে হৃদরোগের চিকিৎসায় বেশ কার্যকর। আজ ২১ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৮১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এ বাকি।
প্রশ্ন : বৃদ্ধ বয়সে হৃদরোগ—এটাকে আমরা আলাদা করলাম কেন? এ বিষয়টি আপনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন করেছেন। এর কারণ কী?
উত্তর : হৃদরোগ সব বয়সেই হতে পারে। ছোট বাচ্চাদের যেমন জন্মগত হৃদরোগ হয়, আবার মধ্য বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ রক্তচাপ থেকে হার্টের ব্লকজনিত হৃদরোগ ইত্যাদি হতে পারে। তবে বৃদ্ধ বয়সের হৃদরোগকে একটু আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো, বৃদ্ধ বয়সে যখন হৃদরোগ হয়, বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক অথবা হার্টের রক্তনালি ব্লকজনিত কোনো সমস্যা থাকলে অনেক সময় বয়স বিবেচনা করে, তাঁদের যে স্বাস্থ্যগত অবস্থা সেটি চিন্তা করে, হার্টের যে অস্ত্রোপচার জাতীয় চিকিৎসা আছে, সেটি দেওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যায়। তখন তাঁদের চিকিৎসার বিষয়ে কিছুটা আমরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। এ জন্য বৃদ্ধ বয়সের হৃদরোগকে একটু আলাদাভাবে ভাগ করা যায়।
প্রশ্ন : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগব্যাধি বেড়ে যায়। ফলে একটি জটিলতা তৈরি হয় ...
উত্তর : আসলেই তাই। আপনি যে কথাটি বলছিলেন আমার রেশ ধরে সেটা হলো, আপনি জানেন যে বৃদ্ধ বয়সে একই সঙ্গে কিডনির কার্যক্রম খারাপ হয় এবং বৃদ্ধ বয়স আসার আগেই কারো মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়ে যায়। সে কারণে যখন এই পর্যায়ে গিয়ে হার্টের অ্যাটাক হয়, হার্টের রক্তনালি ব্লক হয়ে যায়, তখন সমস্যাটি জটিল হয়ে পড়ে। আপনি জানেন যে হার্টের রক্তনালি ব্লক হলে আমরা প্রথম চিকিৎসা হিসেবে এনজিওগ্রাম করে রক্তনালি স্টেন পরিয়ে দিই অথবা বাইপাস করি। তবে দেখা যায়, বৃদ্ধ বয়সের কারণে, কিডনি ফেইলিউরের কারণ বা স্ট্রোকের কারণে অথবা অন্য কোনো রোগের কারণে, কোনো অস্ত্রোপচারের ঝুঁকিতে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেসব ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক রিহ্যাব বলে একটি বিষয় আছে, হৃদরোগ পুনর্বাসন চিকিৎসা, ইইসিপি এবং ইএসএমআর। এটা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। এবং যাঁদের জন্য বাইপাস বা রিং বসানো যায় না, এগুলো না বসানোর কারণে চিকিৎসকরাও একটু অসহায়ত্ববোধ করেন, তখন রোগীদের শুধু লিখে দেওয়া হয় এক্সটেনসিভ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট। শুধু ওষুধের ওপর আপনি থাকেন। ওষুধের ওপরে তার লক্ষণগুলোকে সব সময় দূর করা যায় না। সেসব ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক রিহ্যাব বা ইইসিপি, ইএসএমআর খুবই উপকারী চিকিৎসা হিসেবে সাহায্য করতে পারে।urgentPhoto
প্রশ্ন : ইইসিপি ও ইএসএমআর বিষয়টি কী এবং বৃদ্ধ বয়সে যখন কোনো চিকিৎসায় তেমনভাবে করা যাচ্ছে না, তখন এটা কীভাবে সাহায্য করে?
উত্তর : ইইসিপি ও ইএসএমআর দুটোই হলো নন-ইনভেসিভ। তার মানে বিনা অস্ত্রোপচারে হয়। ইনভেসিভ মানে হলো ভেতরে ঢুকে কাটাছেঁড়া করে যে চিকিৎসাগুলো আমরা করি সেটি। তবে এই চিকিৎসা হলো নন-ইনভেসিভ। এখানে বাইরে থেকে স্টিমুলেশন দিয়ে হার্টের রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করতে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ইইসিপিতে হার্টের যে রক্তনালিগুলো ব্লক থাকে এবং সবার হার্টে কিছু রক্তনালি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এটা অনেক সময় এমনি এমনি ব্যায়াম করলে খুলে যায়। যেটাকে আমরা বলি কোলেট্রাল সার্কুলেশন। ইইসিপিতে যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হয় সেটা হচ্ছে, আপনি তো জানেন হার্ট সব সময় সংকোচন এবং প্রসারণ করছে, যখন প্রসারণ করে তখন হার্টের ভেতর রক্ত ঢুকে এবং সংকোচনের সময় হার্ট সেই রক্তটা বের করে দেয়। ইইসিপিতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যখন হার্ট প্রসারণ করে তখন পা ও শরীরের নিম্নাংশ থেকে চাপের মাধ্যমে আরো বেশি রক্ত হার্টের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। তাতে হার্টে স্বাভাবিকভাবে যে রক্ত প্রবেশ করে প্রসারণের সময়, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত প্রবেশ করে।
আপনি জানেন, কোনো জায়গায় যদি বেশি রক্ত প্রবেশ করে এবং সেটাকে যদি পাম্প করে বের করে দিতে হয়, তাহলে কিছু অতিরিক্ত জায়গা লাগে। এই যে অতিরিক্ত রক্ত হার্ট বারবার বের করে দিচ্ছে, যার জন্য হার্টের যেসব সুপ্ত রক্তনালি থাকে এগুলো ধীরে ধীরে খুলে যায়।
আমরা অনেক সময় এনজিওগ্রাম করে দেখেছি যে একটি রক্তনালি সম্পূর্ণ ব্লক। তবে আমরা পরামর্শ দিই আপনার কিছু করা লাগবে না। কারণ আমরা দেখছি যে এই ভদ্রলোক হয়তো ব্যায়াম করত অথবা এই ব্লকটা ধীরে ধীরে হওয়ার কারণে অন্যান্য শাখা খুলে গেছে। এবং অন্য রক্তনালি থেকে শাখা রক্তনালি যে জায়গায় রক্ত পাচ্ছে না, সে জায়গায় যোগ করছে। এটাকে কোলেট্রারাল বলা হয়।
এই হার্টথেরাপি ৩৫ দিনের একটি কার্যক্রম। এটা অনেকটা ফিজিওথেরাপির মতো। এটি পায়ের রক্তনালিকে হার্টের প্রতি সংকোচনের সঙ্গে সংগতি রেখে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে করা হয়। একে একটা ব্যায়ামের কার্যক্রম বলা যেতে পারে, যাতে হার্টের ভেতর অধিকতর রক্ত সংকোচন করা হয়। এবং ধীরে ধীরে দেখা যায়, এটা প্রমাণিত যে এতে কোলেট্রারাল বা শাখা রক্তনালিগুলো প্রকাশিত হয়। এতে হার্টের রক্তনালি ব্লক হওয়ার জন্য, হার্টের মাংসপিণ্ড রক্ত পেত না, সে জায়গায় বিকল্প পথে রক্ত সরবরাহ করা হয়।
প্রশ্ন : প্রতিদিন কতক্ষণ করে নিতে হয়?
উত্তর : প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে ৩৫ দিন নিতে হয়। এবং এখানে কোনো ধরনের ব্যথা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। সুতরাং বৃদ্ধ বয়স হোক, তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা খারাপ হোক, সে ক্ষেত্রেও এখানে কোনোরকম অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন : এর খরচ কেমন আমাদের দেশে?
উত্তর : এর খরচ বাংলাদেশে এক লাখ ২০ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
প্রশ্ন : ইইসিপি করার পর কী ভবিষ্যতে আবারো সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : ভবিষ্যতে আসলে হয় কী, আমাদের রক্তনালিগুলো যে ব্লক হচ্ছে, ব্লকের যে প্রতিক্রিয়া এগুলো চলমান। আমরা যদি আজকে বাইপাস সার্জারি করি, ওই যে আগে আপনাকে অন্য প্রসঙ্গে বলছিলাম, অনেক সময় রোগী আমাদের বলে যে ১০০ শতাংশ ভালো হয় কি না। বাইপাস সার্জারি করে আজকে আমি পথটা ঠিক করে দিলাম, তবে দেখা যায় ১০ বছরের মধ্যে ৮০ ভাগ এই পথগুলো আবার ব্লক হয়ে যায়। অথবা আমি যদি একজন রোগীকে রিং লাগিয়ে দিই, তখন কয়েক বছর পর ওই জায়গায় বা অন্য জায়গায় ব্লক হতেই পারে। সুতরাং এই ভদ্রলোক এই থেরাপি নেওয়ার পর যদি আবারো কয়েক বছর পর এ সমস্যা হয়। তবে সে এটা আবার করতে পারে।
আরেকটি যেটা পদ্ধতি রয়েছে একে ইএসএমআর বলা হয়। এখানে এক ধরনের সাউন্ড ওয়েভ (শব্দতরঙ্গ) একটি যন্ত্রের মাধ্যমে হার্টের দুর্বল অংশগুলোকে ইকোর মাধ্যমে দেখে ঠিক করা হয়। এটাতেও যে জায়গাগুলোতে হার্ট রক্ত পাচ্ছে না, আমাদের পরিভাষায় ইসকেমিক মায়োকার্ডিয়াম বলি, সে জায়গাগুলোতে নতুন রক্তনালি তৈরি হয়। এবং একইভাবে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে একটি বিকল্প রক্ত চলাচল ব্যবস্থা তৈরি হয়। রোগীর যে কষ্ট, রক্ত না পাওয়ার জন্য যে এনজাইনা বা শ্বাসকষ্ট, সেটা অনেকখানি কমে আসে।