বয়স্কদের খাবারদাবার কেমন হবে
বহুদিন আগে থেকে পুষ্টিবিদরা অনুভব করছিলেন, স্বল্প বয়স্করা যে খাবার খান, বয়স্কদেরও সে খাবার খেতে হবে, যদিও তা হবে কম ক্যালরিযুক্ত। কেননা, বয়স্কদের মধ্যে শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম।
আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর আগে এক নির্দেশিত খাদ্য তালিকায় দুটি দলের জন্য ক্যালরির চাহিদার পরিমাপ উল্লেখ করা হয়েছিল। একটা ৫১ বছরের কম বয়সীর জন্য, অন্যটা ৫১ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত। সব ব্যক্তিকেই একই খাবার খেতে বলা হয়েছে। আবার এ নির্দেশদানের প্রাক্কালে যে পরীক্ষা করা হয়েছে, তা পরিচালিত হয়েছে সুস্থ সবল স্বল্প বয়স্কদের ওপর। সুতরাং এখানে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।
আমেরিকায় নিউট্রিশন অ্যান্ড এজিং (পুষ্টি ও বার্ধক্য) নামক রচনায় বিখ্যাত পুষ্টিবিদ আরউইন রোজেনবার্গ উল্লেখ করেছেন, এই শতাব্দীর শুরুতে যেখানে মানুষের গড় বয়স ছিল ৪৭, সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য আমরা আজকাল ৭৪ বছর বয়সে পৌঁছেছি। ৭৪ বছর বয়সীদের সঙ্গে ৯০ বছর বয়সীদের অনেক পার্থক্য আছে। আবার ৭০ বছরের বিভিন্ন পুরুষের মধ্যেও প্রচুর পার্থক্য দেখা যায়। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে সব বয়স্ক ব্যক্তিই যে সুস্থ, সবল, স্বনির্ভর থাকবেন, তা কিন্তু ঠিক কথা নয়। অনেক লোকও পাওয়া যাবে, যাঁরা দুর্বল, বহুদিন ধরে অসুখে ভুগছেন, পরনির্ভর এবং বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি আছেন। আজকের বিজ্ঞানীদের চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত এই, যেন আগামী দিনগুলোতে আরো বেশিসংখ্যক বয়স্ক লোক সুস্থ, সবল কর্মক্ষম থাকতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বয়স্কদের জন্য ‘বিশেষ পুষ্টি চাহিদা’ নিয়ে যে গবেষণা চলছে, তা এখনো তার শৈশবে অবস্থান করছে।
তবুও আশা করছি, সত্বর এদের জন্য কোনো ‘নির্দেশিত পুষ্টি চাহিদা’ প্রকাশিত হবে। এ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই আমরা হয়তো এবং বার্ধক্য জর্জরিতদের খাদ্য চাহিদা সম্বন্ধে সম্যক জানতে পারব, তথাপি এরই মধ্যে আমরা যতটুকু জানি, তা হয়তো এই বয়স্ক ব্যক্তিদের অনেকখানি ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
রোজেনবার্গ মনে করেন, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে চলা উচিত।
* একজন মানুষের বয়স যখন বাড়তে থাকে এবং যখন কাজের পরিমাণ কমে যেতে থাকে, তখন শরীরের পেশিভরও কমে যেতে থাকে। এতে এ ধরনের ব্যক্তির ক্যালরিক চাহিদাও হয় স্বভাবতই কিছুটা কম। কিন্তু কম ক্যালরিযুক্ত খাবারে পুষ্টির প্রতিটি অংশ মেটানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে, যে শরীর বেশি কাজ করবে, ব্যায়াম করবে, তার জন্য আবার ক্যালরিক চাহিদাও বেশি হবে এবং ক্যালরিক চাহিদা অপেক্ষাকৃত যতটা বেশি হবে, ততই সুষম খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। অতএব মনে রাখবেন, বিশেষত বয়স্কদের শরীর সুস্থ, সবল, নীরোগ রাখতে অবশ্যই কাজ করতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে।
* যদিও বয়স্ককালের পেশিলুপ্তিকে বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট প্রোটিন বা আমিষ প্রয়োজন, তবুও লক্ষ রাখতে হবে যেন এই আমিষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না খাওয়া হয়। অধিক বয়সে বৃক্ক বা কিডনির কার্যকারিতা কমে যেতে থাকে। এতে অতিরিক্ত প্রোটিন এই বৃক্কের ওপর অবর্ণনীয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, মেপে মেপে আপনাদের প্রোটিন খেতে হবে।
* ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, সমপরিমাণ ভিটামিন-‘এ’, যা চর্বিতে দ্রবণীয়, তরুণ ও বয়স্কদের দেওয়া হলেও দুই দলের রক্তে এটির মাত্রা দুই রকমের। অতএব, এ ভিটামিন বয়স্কদের শরীরে জমা হতে হতে ক্ষতিকর মাত্রায় উঠে যেতে পারে।
* বয়স্কদের মধ্যে বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনগুলোর জন্য প্রধান দায়ী হচ্ছে বিপাকীয় জারণপ্রক্রিয়া। ফলে বয়স্কদের এই জারণপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন খাবার বেশি গ্রহণ করা উচিত। এমন দুটো খাদ্যাংশ হচ্ছে ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই। দেখা গেছে, ভিটামিন-‘সি’ বয়স্কদের চোখে যে ছাবি (ক্যাটার্যাক্ট) পড়ে, তা বন্ধ করতে পারে বা শ্লথ করতে পারে এবং ভিটামিন-ই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
* আমরা জানি, ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে অস্টিওপরোসিসের (বয়সকালে হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভঙ্গুর অবস্থানপ্রাপ্ত হয়।) আশঙ্কা কমানো যায়, বিশেষ রজঃনিবৃত্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে। আবার আমরা এও জানি, ব্যায়াম বা কাজ হাড়কে শক্ত ও সুগঠিত রাখার শ্রেষ্ঠতম উপায়। অতএব, যে বয়স্ক ব্যক্তিরা কাজ করেন, ব্যায়াম করেন, তাঁদের জন্য অবশ্যই ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন বেশিই লাগবে।
* বয়স্কদের মধ্যে যখন ভিটামিন বি-৬ (পাইরিডক্সিন)-এর ঘাটতি হয়, তখন তরুণদের তুলনায় এদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন বেশি দেখা যায়। অতএব, বুড়ো মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম রাখার জন্য এই খাদ্যাংশের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৭০ বছরের পর পাকস্থলী হতে প্রায়ই কম পরিমাণ এসিড নিঃসৃত হয়। তাই লৌহ, ফলিক এসিড অবশ্যই বেশি করে গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।