জিমে অনুশীলনের সময় সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর উপায়
শরীরচর্চার সঠিক কৌশলের মাধ্যমে সুঠাম দেহ গঠনের ক্ষেত্রে জিমে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই থাকে কিছু সতর্কতার প্রশ্ন। কেননা শরীর গঠনের ষোলকলার পাশাপাশি জিমে যেসব উপকরণ থাকে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার না জানলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
তাই, জিম করার সময় কোনো ধরনের বিপদ হতে পারে এবং সেগুলো এড়িয়ে চলার উপায় জানা জরুরি। চলুন, জিম করার সময়কে আশঙ্কামুক্ত করতে আগেভাগেই এই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
জিমে ১০টি বিপদ ও সেগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায়
জিমের উপকরণে ত্রুটি
জিমে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকে, যেগুলোর প্রত্যেকটির কাজ ভিন্ন ভিন্ন। জিমের নতুন সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম এগুলো ব্যবহার করতে যেয়ে মুশকিলে পড়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে আকারে বড় ও ভারি ওজনের সরঞ্জামগুলো নতুনদের জন্য বেশ বিপদজ্জনক। অসাবধানতাবশত এগুলোর যে কোনোটির ভুল ব্যবহার শুধু উপকরণটির ক্ষতি নয়, ব্যবহারকারীর জন্যও গুরুতর দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
পরিত্রাণের উপায়
প্রতিবার জিমে প্রবেশের পর প্রথমেই পুরো জিম ঘুরে উপকরণগুলো একবার পরিদর্শন করুন। কোনোটিতে কোনোও অসঙ্গতি চোখে পড়লে অবিলম্বে তা জিম কর্তৃপক্ষকে জানান। সঠিক ব্যবহারের নির্দেশিকা নিয়মিত অনুসরণ করতে করতে এক সময় অভ্যস্ততা চলে আসবে। এছাড়াও ব্যবহার জানার জন্য জিম কর্তপক্ষের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
অনুপযুক্ত শরীরচর্চা ও কৌশল
জিমে ভর্তি হওয়ার মুল কারণ সুষ্ঠু ও সঠিক অনুশীলন, যেটা বাসায় একা একা শরীরচর্চার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। এই পরিমিতির মধ্যে একদম অল্পও ঠিক নয়, আবার সাধ্যের বাইরে অতিরিক্তও ঠিক নয়। আগ্রহ জাহির করতে যেয়ে সাধ্যাতীত অনুশীলন বা বিস্তারিত না জেনে বা না শিখে ভুলভাবে শরীরচর্চা বিপদের কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এমনকি হাল্কা নড়াচড়াও পেশিতে দীর্ঘমেয়াদি আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
পরিত্রাণের উপায়
এর জন্য ফিটনেস সেন্টার এবং তার প্রশিক্ষকদের ব্যাপারে আগেই ভালোভাবে গবেষণা করে নিতে হবে। ভালো একটি জিমের সঙ্গে একবার সংযুক্ত হতে পারলে শরীরচর্চার পুরো প্রক্রিয়াতে দ্বিধাহীন থাকা যায়। প্রশিক্ষকের নির্দেশনা বিস্তারিত মনযোগ দিয়ে শুনুন ও বোঝার চেষ্টা করুন।
পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলে তবেই নিজে নিজে চেষ্টা শুরু করুন। একজন দক্ষ প্রশিক্ষক কখনোই প্রথমে ভারি ও শক্ত অনুশীলনগুলো করার পরামর্শ দেবেন না। বরং হাল্কা ও সহজ কাজগুলো সুচারুরূপে করার দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে বলবেন।
অতিরিক্ত চাপে মচকে যাওয়া
ধারাবাহিক অনুশীলনগুলোর যেকোনো পর্যায়ে বেকায়দায় আকস্মিক চাপ পড়তে পারে। এর ফলে হাত বা পা মচকে যেতে পারে। আর জিম থেকে আগ্রহ ছুটে যাওয়ার জন্য এই একটা দুর্ঘটনাই যথেষ্ট।
পরিত্রাণের উপায়
এ ক্ষেত্রে নিজ দেহের সক্ষমতার সীমারেখা সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরি। এই সীমারেখা সবার জন্য এক নয়। ধারাবাহিক উন্নতির জন্য অধৈর্য হওয়া যাবে না। তীব্র কসরতের মাঝে মাঝে নিয়মিত বিশ্রাম নিন। নিজের সক্ষমতার সীমার কাছাকাছি জায়গাগুলোতে ধৈর্য্য নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হন। এতে আঘাতের ঝুঁকি কমবে এবং দেরিতে হলেও ইতিবাচক ফলাফল আসবে।
পিছলে বা কোনো ভাবে পড়ে যাওয়া
ভেজা মেঝে ও বিক্ষিপ্ত সরঞ্জামের মধ্যে অনুশীলন করা ঠিক নয়। এমনকি অনুপযুক্ত জুতাও পিছলে যাওয়ার উপক্রম ঘটাতে পারে। দৌড়, লাফ, এমনকি স্বাভাবিক চলাচলের সময়েও মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
পরিত্রাণের উপায়
চলাচলের সময় সর্বদা পায়ের নিচের মাটির দিকে খেয়াল রাখুন। কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা বা উঁচু-নিচু জায়গা আছে কি না দেখে নিন। জিমের মেঝে সঠিকভাবে পরিষ্কার রাখাটা জরুরি। আর সরঞ্জামগুলো সুন্দরভাবে গোছানো অবস্থায় থাকা উচিত। এই ব্যাপারে জিম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলুন। পর্যাপ্ত গ্রিপযুক্ত উপযুক্ত স্নিকার বা কেডস পরুন।
অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ক্লান্তি
নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে মরিয়া হয়ে অনেকেই তাদের সাধ্যাতীত অনুশীলনে দিকে ঝুঁকে পড়েন। আর এই অতিরিক্ত পরিশ্রম ক্রমশ দেহকে ক্লান্তির দিকে নিয়ে যায়। পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবে শরীর নতুন উদ্যমে তার কাজ করার শক্তি পায় না।
পরিত্রাণের উপায়
এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ এবং নিজের সক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য করতে হবে। ক্লান্তির লক্ষণগুলো দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সুস্থ হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিন। পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম পুষ্টি এবং পরিমাণ মতো পানি পান শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে। ধীরে ধীরে ওয়ার্কআউটে অগ্রগতি করুন। খেয়াল রাখুন- শরীর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে কি না।
অতিরিক্ত সংকোচন বা প্রসারণে পেশি ছিঁড়ে যাওয়া
শরীরকে ইস্পাত কঠিন বানাতে যেয়ে অনেকেই নিজেদের পেশি সংকোচন-প্রসারণে প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। এর চরম সীমায় পেশি ছিঁড়ে যেতে পারে। আর তখন হাল্কা ব্যায়ামগুলোও করা কঠিন হয়ে পড়বে।
পরিত্রাণের উপায়
প্রতি অনুশীলনের শুরুতে একটি ওয়ার্ম-আপ করুন। এতে করে শরীরের পেশির তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। অতঃপর ওয়ার্কআউটে অল্প অল্প করে ওভারলোড প্রয়োগ করুন। সময়ে নিয়ে ধীরে ধীরে তীব্রতা বৃদ্ধি করুন।
এভাবে অনুশীলন করলে পেশিগুলো পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। ব্যায়াম করার সময় সঠিক কৌশল মেনে চলুন। যেকোনো ধরনের আকস্মিক নড়াচড়া এড়িয়ে চলুন।
অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধান বা নির্দেশিকা
সঠিক নির্দেশনা ছাড়া জিম যন্ত্রপাতির অপব্যবহার বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এছাড়াও ব্যায়াম ও ব্যায়ামের কৌশল সম্বন্ধে জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। আর এভাবে চালিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যকে ভয়াবহ ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়।
পরিত্রাণের উপায়
এর জন্য প্রশিক্ষক বা কোচকে অবশ্যই প্রত্যয়িত এবং দক্ষ হতে হবে। সর্বপ্রথম লক্ষ্য স্থির করুন, অতঃপর আপনার সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওয়ার্কআউট পরিকল্পনার জন্য নির্দেশিকা গ্রহণ করুন। প্রশিক্ষকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন, নির্দেশাবলীতে স্পষ্টতা এবং সঠিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন। তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিন যে, প্রতিটি ব্যায়াম আপনি নির্ভুল ভাবে সম্পাদন করতে পারছেন কিনা।
পানির স্বল্পতা ও তাপ-জনিত অসুস্থতা
জিমের সুস্থ পরিবেশে পানির স্বল্পতা এবং উচ্চ তাপের প্রভাবগুলো একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। তীব্র ওয়ার্কআউটের সময় দেহের পর্যাপ্ত পানির চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে।
পরিত্রাণের উপায়
দেহে প্রয়োজনীয় পানির যোগান দিতে ব্যায়ামের আগে, ব্যায়ামের সময় ও পরে পানি পান করুন। তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া বা মাথা ঘোরার মতো লক্ষণগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা সময় এবং জায়গাকে ওয়ার্কআউটের জন্য বেঁছে নিন। উত্তাপ থেকে বাঁচতে এমন জায়গা বেঁছে নিন যেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল হয়।
ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া
ব্যবহার জানার পরেও অনেক সময় দুর্ঘটনাবশত ইলেকট্রনিক জিম সরঞ্জাম থেকে বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। ত্রুটিপূর্ণ তার, ক্ষতিগ্রস্ত কর্ড, ভেজা বা পানির কাছাকাছি জায়গায় ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো প্রাণনাশের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
পরিত্রাণের উপায়
সমস্ত ইলেকট্রনিক জিম সরঞ্জাম সঠিকভাবে পরীক্ষিত কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। প্রতিবার জিমে প্রবেশের পর সব সরঞ্জামগুলো ঘুরে দেখার সময় কর্ড এবং তারগুলো লক্ষ্য করুন। ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো ব্যবহারের সময় খেয়াল করুন জায়গাটি শুকনো কি না। যে কোনো ত্রুটি চোখে পড়লে অবিলম্বে তা মেরামত বা প্রতিস্থাপনের জন্য জিম কর্মীদের অবহিত করুন।
শরীরচর্চায় অন্য কারোর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়া
অনুশীলনের সময় অনিচ্ছায় অন্যান্য অনুশীলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। জিমের সবচেয়ে ব্যস্ত মুহূর্তে তাড়াহুড়োর কারণেও এ রকম ধাক্কা লাগতে পারে। যেহেতু আশেপাশে অনেক ভারি ও শক্ত যন্ত্রপাতির সমাহার, তাই এ রকম ছোটখাটো ধাক্কা থেকে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা অমূলক নয়।
পরিত্রাণের উপায়
এ ক্ষেত্রে সর্বদা পার্শ্ববর্তী শরীরচর্চারত ব্যক্তিদের ব্যাপারে সচেতন থাকুন। অনুশীলনের সময় অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। বিশেষ করে যে অনুশীলনগুলোতে অতিরিক্ত জায়গা প্রয়োজন এবং বড় সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। এর সঙ্গে জিমের শিষ্টাচার মেনে চলুন এবং মনোযোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন বিভ্রান্তিকর কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন।
পূর্ব সতর্কতা জিম করার প্রতি আগ্রহীদের মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তুলতে যথেষ্ট। সেখানে জিম করার সময় ১০টি বিপদ ও এগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। এই বোধগম্যতা শুধু যে মানসিক প্রতিকূলতা দূর করবে তা নয়, শরীরচর্চার পুরো প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিবে অক্ষত অবস্থায়।