ফলের রস বিক্রি করে লাখ টাকা
ভারতের তমিলনাড়ু বা চেন্নাইয়ের কথা কমবেশি সবাই জানেন, বিশেষ করে দুটি কারণে। এক, স্বল্প টাকায় আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা হয় চেন্নাই বা মাদ্রাজে। দুই, রজনীকান্ত, নাগার্জুন, প্রবাস, কাজল আগারওয়াল, তামান্নাদের তামিল চলচ্চিত্র। মহীশুরের বীর টিপু সুলতানের ঐতিহাসিক দুর্গও তামিলনাড়ুর ভেলরে।
চেন্নাই থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বে পাহাড় ঘেঁষা ছোট্ট শহর ভেলর। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত সিএমসি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে জেলা শহরটি।
প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে দেশের নানা প্রদেশ থেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ভিড় করেন এখানে, যার কারণে এখানকার প্রধান জীবিকা হোটেল ব্যাবসা। এ ছাড়া চিকিৎসা নিতে আসাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বেচাবিক্রির ব্যবসাও বেশ জমজমাট।
ক্রিশ্চান মেডিকেল সেন্টার বা সিএমসির প্রবেশপথে চোখ আটকে যায় রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানে। টকটকে মালটা, কমলা দিয়ে সাজানো একটি ভ্যান। একপাশে মাঝবয়সী মানুষের সঙ্গে দুই কিশোর জুস তৈরি করছে। একজন কমলা খোসা ছড়াচ্ছে, আরেকজন হাতে চালিত ব্লেন্ডারের সাহায্যে সেটাকে জুসে রূপান্তরিত করছে। তৃতীয়জন গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিট লবণ বা চিনি মিশিয়ে পরিবেশন করছে। সবাই ব্যস্ত।
সিএমসির প্রধান গেটের বিপরীত পাশের ফুটপাত থেকে ২০ রুপি দিয়ে এক গ্লাস কমলা, মালটা ও স্থানীয় ফল মুসাব্বির জুস কিনে খাননি এমন রোগী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়া চোখের সামনে বানানো জুসের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ নিয়ে কারো মনে সংশয় থাকার কথা নয়। ভোর ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলে জুস বিক্রি।
এই ভ্রাম্যমাণ জুস মিলের মালিকের নাম মোহাম্মাদ মাইনুদ্দিন (৪৫)। তাঁর বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। ২০০২ সালে নিজে চিকিৎসার জন্য ভেলর এসে এই ব্যবসার ধারণা মাথায় ঢোকে। আগ্রা থেকে হাতে জুস বানানোর মেশিনটি কেনেন পাঁচ হাজার রুপি দিয়ে। পাশেই বড় ফলের বাজার থেকে প্রতিদিন ভোরে নিজে গিয়ে ফল কেনেন। ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়লে তিন ছেলেমেয়ে, দুই ভাগ্নেসহ পুরো পরিবারকে উত্তরপ্রদেশ থেকে এখানেই নিয়ে আসেন।
ভাগ্নে রুখসাদ সব সময় দোকানে থাকে। সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে রুখসাদ ক্লাসের ফাঁকে সময় দেয়। কেমন চলছে—জানতে চাইলে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো আছি।’
মামা-ভাগ্নের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন গড়ে ৭০০ গ্লাস জুস বিক্রি হয়। প্রতি গ্লাসে খরচ হয় ১৫ টাকা। তার মানে দিনে লাভ থাকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাবে মাসিক মুনাফা এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। রাস্তার পাশে জুস বেঁচে মাসে লাখ টাকা আয় করা যায়, এঁদের সঙ্গে কথা না বললে অজানাই থেকে যেত।
মাইনুদ্দিন ছেলেকে মাঠের কাজ করান না, স্বপ্ন দেখেন পড়াশোনা করে ছেলে বড় হবে। কার মতো বড় হতে চাও—জানতে চাইলে মিষ্টি হেসে ছেলে ফায়াস বলে, ‘রাষ্ট্রপতি আবুল কালামের মতো।’
একটা কথা ঘুরেফিরে মাথায় আসছিল, ফলে ফরমালিন আছে কি না? জানতে চাইলে পাশ থেকে ভাগ্নে বলে ওঠে, ‘ফরমালিন হ্যায়, বহত জাদা ফরমালিন হ্যায়।’ খটকা লাগল, ভালো করে জানতে চাইলাম, ফলে কেমিক্যাল মেশানো হয় কি না? এবার মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে জিহ্বায় কামড় দিলেন। রোগীর খাবারে কেমিক্যাল? ‘কাভি নেহি।’ এবার বুঝলাম ‘ফরমালিন’ শব্দটা এর আগে উনারা বোঝেননি।
মাস্তানকে টোল দিতে হয় না। তবে স্থানীয় থানার পুলিশ মাস শেষে এসে দুই হাজার রুপি নিয়ে যায়। পুলিশকে ঘুষ দেওয়া অন্যায়, কেন দেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘যে ব্যবসার কারণে গ্রামের মাটির ঘর ভেঙে পাকা ঘর করতে পেরেছি, সে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে একটু অন্যায় করতে হবে। এ ছাড়া তো উপায় নাই।’ বুঝলাম, দেশ বা পোশাক বদলে গেলেও এই পেশার মানুষের স্বভাব মাঝেমধ্যে একই থাকে।