উচ্চআদালতে মাতৃভাষার টানে কিছু রায় বাংলায়
আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষ ইংরেজিতে শুনানি করেন, বেশির ভাগ রায়-আদেশও দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষায়। আদালতের বেঞ্চ কর্মকর্তারা মামলার নম্বর ধরে ইংরেজিতে ডাক দেন। এখনও বর্ষপঞ্জি এবং দৈনন্দিন মামলার কার্যতালিকা বেঞ্চভিত্তিক ওয়েবসাইটে মেলে ইংরেজিতেই। বলা হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কথা। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সুপ্রিম কোর্টে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বাংলা ভাষার ব্যবহার।
তবে, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন। তাঁদের মধ্যে একজন বিচারপতি ১৩ বছর এবং অপরজন ১০ বছর ধরে বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। এ ছাড়া একজন বিচারপতি বছরজুড়ে বাংলায় কিছু রায়ের পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষায় রায় লেখেন।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগে ৯৩ জন বিচারপতি রয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগে ৮৬ জন এবং আপিল বিভাগে সাত জন বিচারপতি রয়েছেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তিনি বাংলা ভাষায় রায় লিখছেন। তিনি ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ সহস্রাধিক রায় লিখেছেন বাংলায়। এ ছাড়া বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ২০১২ সালে স্থায়ী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে তিনি বাংলায় রায় লিখছেন।
বাংলায় এ রায়ের ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ স্বস্তিবোধ করছে। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন চাঁদপুরে নৌকাডুবিতে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় বাংলায় রায় দিয়েছেন। যে মামলায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ইংরেজিতে শুনানি করেছেন।
অপরদিকে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীর দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। সে রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী।
সদ্য আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টে থাকাকালীন বেশির ভাগ রায়, আদেশ ও নির্দেশ বাংলায় দিয়েছেন। তিনি ৫ হাজারের বেশি রায় বা আদেশ বাংলায় দিয়েছেন।
২০২০ সাল থেকে ভাষার মাসে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। সে বছর ভাষার মাসে তিনি বিভিন্ন মামলায় এক হাজার ১৭৫টি রায় এবং ৬৩৭টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই বেঞ্চ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার আলোচিত মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়।
এ ছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি জাহিদ সারোয়ার কাজলসহ অনেক বিচারপতিই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। অনেক বিচারপতি এখন ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েও বাংলায় রায় লেখেন।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্র জানায়, এক সময় বাংলায় রায় কিংবা আদেশ দেওয়া চিন্তা করাও কঠিন ছিল। তবে বর্তমানে বিচারপতিদের যাঁরা বাংলায় রায় লেখেন, তাঁরা তা লিখছেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে। বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তাঁরা।
১৯৯৯ সালে উচ্চআদালতের কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে কোনো রায় বাংলা ভাষায় দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় লেখেন।
এদিকে, ইংরেজিতে দেওয়া আদালতের রায়গুলো সহজেই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘আমার ভাষা’ নামের একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, “‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করা যায়। রায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করে জনসাধারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রচার করা হচ্ছে। সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরি করে এরই মধ্যে অনুবাদকদের দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে অনুবাদ করেছেন, যা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।”
এ ছাড়া ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও দূরদর্শনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং দূষণরোধে হাইকোর্ট রুলসহ নির্দেশনা দেন। দুটি নির্দেশনাই দেওয়া হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এখনও কার্যকর হয়নি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়াটা অত্যাবশ্যক। কারণ, দেশের নাগরিক—বিশেষ করে যাঁরা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন—তাঁদের মামলার রায় ও আদেশ মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া আমরা বহু আগেই ঔপনিবেশিক আমল পেরিয়ে এসেছি। তাই সে মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসাও অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অন্তত বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। এক সময় ছিল আদালতের সবকিছু ইংরেজি ভাষায় পরিচালনা করা হতো, এখন সে পরিস্থিতি নেই। দিন দিন বাংলা ভাষার কদর আদালতে বাড়ছে। অনেক বিচারপতি আছেন, যাঁরা নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন।’
উচ্চআদালতে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ শনিবার বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ইংরেজিতে রায় লেখা বা আবেদন করা বাধ্যতামূলক নয়। ইচ্ছা করলে বাংলায়ও রায় লেখা যাবে। কোনো কোনো বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন। তবে, সংখ্যায় খুবই কম। আমাদের আইনের বইগুলো ইংরেজিতে। এখন অবশ্য বাংলায় লেখা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আস্তে আস্তে এটার পরিবর্তন হবে। এতে সরকারকে মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। অন্য ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করতেও কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উচ্চআদালতে এখন বাংলায় রায় দেওয়া বাড়ছে। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়মিত চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়।’