এজাহার ও চার্জশিটে রাকিবের স্ত্রী সন্তানকে লোমহর্ষক হত্যার বর্ণনা
রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় দুই শিশু সন্তানসহ স্ত্রীকে লোমহর্ষকভাবে হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের (বিটিসিএল) সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনের বিরুদ্ধে আজ মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) রায় ঘোষণা করবেন আদালত।
ঢাকা মহানগর ৭ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক তেহসিন ইফতেখারের আজ এ রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। আদালতের অতিরিক্ত পিপি মাহবুবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলার এজাহার ও চার্জশিট থেকে ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ‘নিহত মুন্নী রহমান (৩৭) ও রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটন (৪৬) সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাতশালা গ্রামে। রাজধানীতে দক্ষিণ খানের প্রেমবাগান এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। মামলার বাদি নিহত মুন্নির ভগ্নিপতি সোহেল আহমেদ বলেন, প্রেম করে প্রায় এক যুগ আগে তারা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের মোবাইলফোন বন্ধ ছিল। তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল বলেই আমরা জানতাম।’
মামলার বাদি নিহত মুন্নি রহমানের বড় ভাই মুন্না রহমান ঘটনার পর ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ থানায় হাজির হয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘আমি মুন্না রহমান (৪২) থানায় হাজির হয়ে অভিযোগ করছি যে, আমার ছোট বোন মুন্নি রহমানের (৩৭) সঙ্গে ১৩ বছর আগে বিবাদী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনের (৪৬) বিয়ে হয়। তাদের দাম্পত্য জীবনে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব (১২) ও লাইবা (৩) নামের দুটি সন্তান আছে। আসামি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে উত্তরায় কর্মরত। ২০১১ সাল থেকে আমার বোন তার পরিবারসহ রাজধানীর দক্ষিণ খানের প্রেমবাগান এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। এ বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস করা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে আমার ছোট বোন মুন্নি রহমান আমাকে মোবাইলফোনে জানায় যে, ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাতের বেলা খাওয়াদাওয়া শেষে আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে সে এবং তার স্বামী রফিক উদ্দিন আহম্মেদ বাচ্চাসহ একত্রে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে সকাল সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, তার স্বামী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ বাসায় নাই। অনেক খোঁজ করার পরও তার সন্ধান পাওয়া যায় না। পরে আমি আমার বোন মুন্নি রহমানের বাসার উদ্দেশে রওনা হই। বিকেলে উপস্থিত হয়ে ঘটনার বিস্তারিত শুনি। পরে আমাদের নিকটতম আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তারপর বিবাদীর (আমার বোন জামাই) ভাই সোহেল আহম্মেদ রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় উপস্থিত হয়ে নিখোঁজ হয়েছে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।’
জিডির পর জানতে পারি যে, ‘বিবাদী কুমিল্লার বুড়িচং থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। এ খবর পাওয়ার পর আমিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ওই থানায় গিয়ে জানতে পারি যে, রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ কুমিল্লার বুড়িচং এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিবাদীকে আমার জিম্মায় দিয়ে দেয় পুলিশ। বিবাদী শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাতদিন ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিবাদী কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করেন চিকিৎসক। চিকিৎসা শেষে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার কারণ জানতে চাইলে রাকিব উদ্দিন জানান, তিনি এক কোটি টাকার মতো ঋণগ্রস্ত এবং পাওনাদাররা টাকার জন্য তাকে খোঁজাখুঁজি করছেন।’
হত্যার বিবরণ দিয়ে মামলার বাদী জানান, ‘‘পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইরে থাকার কারণে সোহেল আহম্মেদ আমার খালাত ভাই সজিবকে মুন্নির বাসায় পাঠায়। পরে সজিব আমাকে ফোনে জানায় যে, ‘সব শেষ’। কী হয়েছে আবার জিজ্ঞাসা করলে সজিব পুনরায় একই কথা বলতে থাকে। এরপর বাদির আরেক বড় বোনের জামাই সোহেল আহম্মদকে ফোন করলে তিনি আমাকে বলেন, ‘বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তুমি তাড়াতাড়ি মুন্নির বাসায় আস।’খবর পাওয়ার পর আমি বিকেল পাঁচটার দিকে মুন্নির বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, সেখানে পুলিশসহ আরও লোকজন রয়েছে।”
“পরবর্তীতে সোহেল আহম্মেদ জানান, বিকেল চারটার দিকে মুন্নির বাসার নিচতলায় উপস্থিত হলে বাড়ির মালিকের সঙ্গে মালিকের রুমে বসে সিসি ক্যামেরা চেক করার চেষ্টা করেন। সিসি ক্যামেরা অপারেট করতে না পারায় বাড়ির মালিকসহ তালা চাবির মেকার এনে বাদীর বোনের ফ্ল্যাটের মেইন দরজার তালা খোলার সাথে সাথে রুমের ভেতর থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হয়। বেড রুমে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে সিআইডির কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে মুন্নি রহমান (৩৭) ও ভাগ্নি লাইবা (৩) উভয়ের মৃতদেহ ফ্ল্যাটের পূর্বপাশের রুমের খাটের উপরে চিৎ অবস্থায় এবং ভাগনে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব (১২) এর মৃতদেহ ফ্ল্যাটের পশ্চিম পাশের রুমে মেঝেতে চিৎ অবস্থায় দুর্গন্ধযুক্ত, পচা ফুলা অবস্থায় পায়।”
জিজ্ঞাসাবাদে রাকিবের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর বলেন, ‘১২ ফেব্রুয়ারি সকালে রাকিব, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা দেরিতে নাস্তা করেন। নাস্তা শেষে রাকিব স্ত্রীর সাথে গল্প করেন। গল্প শেষে বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে মুন্নী হালকা ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলে ফারহান পাশের রুমে মোবাইলে গেম খেলছিল, আর মেয়ে লাইবা পাশের এক রুমে টিভি দেখছিল। সে সময়ে হঠাৎ লিটনের মাথায় চিন্তা আসে যে, এই দুনিয়ায় সে তার পরিবারসহ বেঁচে থেকে লাভ কী বরং তাদের সবাইকে মেরে সে নিজে আত্মহত্যা করলে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সন্তানসহ সে নিজে পাওনাদার ও অন্যান্য দুনিয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। তখনই সে তার পাশে থাকা হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে এবং গলা চেপে ধরে। তখন রাকিবের স্ত্রী তাকে বলে, তুমি আমাকে মারলে কেন, এটা বলে সে নিস্তেজ হয়ে যায়। পরে লিটন টিভি রুমে গিয়ে কাপড়ের রশি দিয়ে মেয়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে, মেয়ে মারা যাওয়ার পর আবার সে তার ছেলে ফারহানের রুমে যায়। ছেলে তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। মেয়েকে যে রশি দিয়ে মেরেছিল সেই রশি দিয়ে ছেলের গলায় পেঁচিয়ে ধরে। তখন ছেলে টের পেয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করে। এক পর্যায়ে ছেলে খাট থেকে নিচে পড়ে যায়। তখন লিটন ছেলের বুকের ওপর চড়ে বসে এবং চাপ দিয়ে ধরে। তখন ছেলে বলতে থাকে, বাবা তুমি আমাকে মারতেছ কেন? আমার কী অপরাধ? এই বলে ছেলে লিটনের হাতের ওপর আঁচড়াতে থাকে এবং ছেলের নখের আঁচড়ে লিটনের হাত কেটে যায়। এক পর্যায়ে লিটন ছেলেকে বলে, আমরা এ পৃথিবীতে কেউ থাকব না। আমরা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব বলে ছেলেকেও মেরে ফেলে।’