ক্রিকেট
একটি জয়ের জন্য অপেক্ষা
ফেব্রুয়ারিতে শুরু, মার্চে শেষ। আগুনঝরানো ফাগুনের এই তো সময়। ফাগুনের কথা এলে অবধারিতভাবেই আগুনের কথা আসে। এ বোধহয় ছন্দেরই মহিমা!
এমনিতেও ইতিহাসের খেরোখাতায় মার্চের বাংলাদেশ উত্তপ্ত। অগ্নিঝরা। মিরপুরের সবুজ ক্রিকেট ময়দানে ভারতের বিপক্ষে আজ সেই রণ দামামার উত্তাপ উত্তুঙ্গ হবে। উত্তেজনার পারদ উচ্চ হবে। আজ সেই কষ্টের রাতটা যে ভুলিয়ে দেওয়ার পালা!
আজ আর ভুল নয়। ছন্দবদ্ধ ক্রিকেটে মাঠ কাঁপাক বাংলাদেশ। সেই ২২ মার্চ ২০১২, আর না ফিরুক। ওই রাতটার পর মহারণের ঝংকার তোলা এমন একটা ফাইনালের জন্য ভীষণ রকম অপেক্ষা করেছে বাংলাদেশ। যে অপেক্ষাকে অনন্তকাল বলতে হবে! তার মধুর সমাপন হয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু একটা মধুরতম জয়ের। বেশি কিছু চাইবার নয় শুধু একটা জয় চাই, জয়!
যে জয় বলে দেবে, ‘বাংলাদেশ তুমিই চ্যাম্পিয়ন!’ যে জয় বলে দেবে, ‘তোমার চোখে অশ্রু নয়, আনন্দাশ্রু বর্ষিত হোক বাংলাদেশ!’
আজ বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে মধুর সুরে উচ্চারিত হোক পিট সিগারের সেই জগৎনন্দিত গান ‘আমরা করব জয়’... প্রতিটি জয়েই গাওয়া হয় এই গান। আজ তার উচ্চারণের হর্ষমাত্রা পাগলপ্রায় হোক। আমরাও আজ পাগল হই!
মিরপুরের ভাঙাহাট থেকে উল্লাস-উত্তেজনা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। ঢাকা সারা রাত জেগে থাকুক। বাংলাদেশ আজ অতন্দ্র থাকুক।
২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালের কথা বাংলাদেশ ভোলেনি। নাদের মাঝি থেকে উপেন কৃষক, যার যা সামর্থ্য তা নিয়েই সেদিন লড়েছিল বাংলাদেশ। তখনো বাংলাদেশ আজকের মতো ধারাবাহিক ও বড় দল হয়ে ওঠেনি। এই কথাটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
এবারও একটা মজা আছে। সেবার বাংলাদেশ ওয়ানডেতে ভালো দল হয়ে গেল। এবার টি২০-তে! একেকটা এশিয়া কাপ আসে, আর বাংলাদেশকে বদলে দেয়! জয়তু বাংলাদেশ, জয়তু এশিয়া কাপ!
সেবার তো কাঁদতে হয়েছিল। এবারও! তাই বলে প্রতিবার?
চার বছর আগে বাংলাদেশ খেলেছিল ইতিহাসের প্রথম এশিয়া কাপ ফাইনাল। যোগ করে নিতে হবে কথাটা যে, ওটা ছিল ওয়ানডে ফরম্যাটে। এবার, প্রথম মঞ্চস্থ হলো টি-২০ ফরম্যাটের এশিয়া কাপ। আর প্রথমবারই কিনা ফাইনালে আমাদের দেশ! প্রথম টি-২০ ফরম্যাটের এশীয় শিরোপাটা জিতে মাশরাফিরা তাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথাটাই বলতে পারেন ‘তারপর হব ইতিহাস’।
চার বছর আগের কথা বারবার এসে যায়। মুশফিক-সাকিবের হৃদয়ের গভীরে হুহু করে ওঠা সেই ক্রন্দনদৃশ্য আজও যেন বুকে শেল হয়ে বাধে! সেদিনের জগদ্দল পাথরটা চারটা বছর এই বাংলাদেশ চেপে ছিল। আজ সেটা নামিয়ে ফেলার শ্রেষ্ঠ সুযোগ। ফরম্যাটের বদল হয়েছে তো কী হয়েছে, স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলোতে সেই একই রকম চেনা। আজ মিরপুরে ‘হোক কলরব’ হতেই হবে!
ইতিহাসের প্রথম টি-২০ এশিয়া কাপটা জেতার যোগ্য বাংলাদেশ জয়ের হুংকার দিতেই মাঠে নামবে, এটা মাহেন্দ্র সিং ধোনির ‘ঠান্ডা মস্তিষ্কে’ নাড়া না-দেওয়ার কথা নয়। এই হুংকারেই চার বছর আগের সেই সব হুহু-হাহাকার উড়ে যাক আজ।
এশিয়া কাপটাও ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে মার্চে শেষ হচ্ছে, এটা হয়তো কাকতালীয়ই ফাগুনের মতো। তবে, শেষটা এমন আগুন-বারুদে ঠাসা হবে, একটা উত্তেজনা কাজ করবে স্বাগতিক সমর্থকদের মনে, টিকেটের জন্য রীতিমতো ইতিহাসের রেকর্ড পরিমাণ হাহাকার পড়বে এসব তো সদূরতম কল্পনাতেও ভাবা হয়নি শুরুতে।
টি-২০ ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট বলে খোদ বাংলাদেশ অধিনায়কেরও যে এসব ভাবনায় ছিল তাও তো না। তার দলের তো বরং এতক্ষণে ধর্মশালায় থাকার কথা!
তবুও, এটা একটা ফাইনাল এবং এশিয়া শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই ফাইনালে জয় ভিন্ন অন্য কিছু আর ভাবাই যাচ্ছে না। তা ফাইনালের মঞ্চে গিয়ে অন্য কিছু এক লহমার জন্য হলেও ভাবার অবকাশ কোনো দলই বা কোনোদিন নিয়েছিল?
অঙ্ক-সংখ্যার খেলা ক্রিকেটে তবুও তো কিছু ক্রিকেটীয় কারণ থাকে যেগুলোর জন্য দুটি দলকে আলাদা করে ফেলতে হয়। ফাইনালের মতো বড় ম্যাচেও করতে হয়। সেই পরিসংখ্যান, পেশাদারিত্ব আর অভিজ্ঞতার বলয় দিয়ে হিসাব করলে ভারত স্পষ্টত এগিয়ে। তবে বাংলাদেশ একদম পাশাপাশিই থাকছে আবেগের সমুদ্রসম জোয়ারের কারণে। ২৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামে আজ তাই আবেগ বনাম পেশাদারিত্বের লড়াই-ই হবে। আবেগের জায়গা থেকে বাংলাদেশকেও ফেবারিট বলা যায়!
এই আবেগটাই পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। এখানে তাই অঙ্কের হিসাব মিলিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণেই ম্যাচটা উভয় দলই ৫০-৫০ থেকে শুরু করবে আজ।
এই ৫০-৫০-এ শুরু করার আরেকটা কারণ হলো নেতৃত্ব। অধিনায়ক হিসেবে মহেন্দ্র সিং ধোনির যে ক্রিকেটীয় অর্জন, তা এক কথায় মহাকাব্যিক বলতে হবে। এ নিয়ে কোনো হীনমন্যতায় ভোগার সুযোগই নেই। ভালো অধিনায়ক বলেই এত এত সাফল্য তাঁর।
তবে, আমরা মাশরাফি বিন মুর্তজাকে পিছিয়ে রাখবই না। হ্যাঁ, হয়তো বড় কোনো টুর্নামেন্ট জয়ের কিংবা বিশ্বজয়ের স্বাদ তাঁর পাওয়া হয়নি, তবে বাংলাদেশ যে সবকিছু জয় করতে পারে, সেটা তো এই মানুষটাই স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাই মাশরাফির নেতৃত্বের কারণেই আমরা টক্কর দেব সেয়ানে সেয়ানে।
মাশরাফির বলে-ব্যাটে পারফম্যান্স যাই হোক না কেন, তাঁর অধিনায়কত্বটা এরকম বড় ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য একটা ফ্যাক্টর। ভারতীয়দের এমন বড় ম্যাচ খেলা অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা হয়তো কালেভদ্রে খেলি। সুতরাং, এই যে চাপ-টাপের ব্যাপার আছে, সেগুলো পুরো ৪০টা ওভার সতীর্থদের ওপর থেকে সরিয়ে রাখার একমাত্র যোগ্য মানুষ তিনি। আজ তিনি কয়েকটি দুর্দান্ত চাল দিতে পারলে, ভারতকে কুপোকাত করা কোনো ব্যাপারই না।
মানুষ মাশরাফিকে ভালোবেসে অন্তরের মণিকোঠায় এক ও অদ্বিতীয় নায়কের স্থান দিয়েছে। তিনিই এখন জনতার নায়ক। জনতার অধিনায়ক। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কাণ্ডারি যিনি, তিনি কি শুধুই নায়ক বা অধিনায়ক? তিনি তো মহানায়ক। মাশরাফি তাই মহানায়ক!
এমন মহানায়কও কালেভদ্রে আসেন। হয়তো খুব বেশিদিন আর ২২ গজের ওই ক্রিকেটমঞ্চে থাকবেন না তিনি। যেভাবে একটা তরুণ দলকে ‘টিম বাংলাদেশে’ রূপ দিয়ে ধারাবাহিক ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন, তাতে একটা বড় ট্রফি তো তাঁর পাওনাই হয়ে গেছে। সেই ট্রফিটা আজই উঠুক না!
তাই, আজ যেমন স্লোগান উঠবে ‘বাংলাদেশ... বাংলাদেশ’, তেমনি স্লোগান উঠবে ‘মাশরাফি... মাশরাফি’। মিছিলের মোহনায় আজ আমাদের লিডার একজন মাশরাফি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও/ তারে বহিবারে দাও শক্তি’। মাশরাফির হাতে দেওয়া পতাকাটায় তুমুল শক্তি দিক সমগ্র বাংলাদেশ। আজ শুধু তিনটা ঘণ্টার জন্য হলেও দিক। হারি জিতি নাহি লাজ। আমরা লড়ব আজ ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচগ্র মেদিনী।’
একটি জয়ের জন্য আমাদের অপেক্ষার শেষ নেই... একটা জয় যে বদলে দেবে ইতিহাস। লেখা হবে ইতিহাসের রঙিন খাতা!
জয়তু এশিয়া কাপ! জয়তু বাংলাদেশ!
লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী