নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ : টিআইবি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে বর্তমান সংসদে ৬২ শতাংশ ব্যবসায়ী রয়েছেন। আগের তিনটি এবং এবারের নির্বাচন মিলিয়ে সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। আর গত ১৫ বছরে নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। আজ মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির কার্যালয়ে ‘নির্বাচনি হলফনামার তথ্যচিত্র : জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শীর্ষক এই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য তুলে ধরেছে টিআইবি।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের নির্বাচনে ১৮ জন প্রার্থীর ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) আছে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে পরে মন্ত্রীর বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্য জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, তাঁদের কাছে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে। হলফনামায় তা দেখা যাচ্ছে না।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ওই মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে আবাসন নির্মাণ (রিয়েল স্টেট) ব্যবসা পরিচালনা করছে। সেগুলোর মূল্য ১৬ দশমিক ৬৪ কোটি পাউন্ড বা দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ওই মন্ত্রী তাঁর হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই মন্ত্রী ২০১০ সালে প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ১ দশমিক ৭৩ কোটি পাউন্ড। এরপর ২০১৬ সালে আরেকটি কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য ৭ দশমিক ৩১ কোটি পাউন্ড। ২০১৯ সালে তৃতীয় কোম্পানি খোলেন, যার বর্তমান সম্পদ মূল্য দশমিক ৭৯ কোটি পাউন্ড। তিনি ২০২০ সালে চতুর্থ কোম্পানি চালু করেন, যার সম্পদ মূল্য ২ দশমিক ১৫ কোটি পাউন্ড এবং ২০২১ সালে পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি খোলেন, যেগুলোর বর্তমান সম্পদ মূল্য ৩ দশমিক ২২ কোটি পাউন্ড।
পাশাপাশি জনগণের জানার জন্য টিআইবি ‘হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি’ শীর্ষক একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করেছে। এই ড্যাশবোর্ডে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ছয় হাজার হলফনামার আটটি তথ্যের বহুমাত্রিক-তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখিয়েছে। এই ইন্টারঅ্যাকটিভ ড্যাশবোর্ড থেকে ঘরে বসেই ভোটাররা নিজ এলাকার প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। পরে টিআইবির তৈরি করা নির্বাচনি হলফনামার তথ্যচিত্র তুলে ধরেন এই গবেষণাদলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
তথ্যচিত্র অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে ১৮ প্রার্থীর ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) আছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত। আটজন স্বতন্ত্রপ্রার্থী। এই ১৮ জনের মধ্যে সবার ওপরে আছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, তাঁর সম্পদের (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) মূল্য এক হাজার ৩৪৫ কোটি টাকার বেশি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন এই কাজটি করতে পারে। কিন্তু কেউই তা করে না। এখানে দায়সারাভাবে তথ্য দেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়।
এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তথ্যচিত্র বলছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। ১৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ ভাগ।
ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির ভূমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ১০০ বিঘা পর্যন্ত। তথ্যচিত্রে বলা হয়, হলফনামা অনুযায়ী, অনেক প্রার্থীর নামেই বড় আকারের ভূমির মালিকানা রয়েছে।
তথ্যচিত্র অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনেও নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ খুব কম। এই হার মাত্র ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, পুরুষ প্রার্থী ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এবারের প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ ব্যবসায়ী (মূল পেশা বিবেচনায়)। অন্যদিকে, রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রার্থী।
উল্লিখিত মন্ত্রীর নাম জানতেই চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু তথ্য গোপনের ব্যাপার রয়েছে এবং তিনি (মন্ত্রী) নিজে তা প্রকাশ করেননি, তাই টিআইবি তাঁর নাম প্রকাশ করছে না। তবে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ যদি টিআইবির কাছে জানতে চায়, তাহলে তাঁরা তথ্য-প্রমাণসহ তা দেবেন।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, হলফনামার তথ্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও উদ্বেগজনক। প্রার্থীদের হলফনামা দেখে ভোটার যদি মনে করেন, তিনি এই প্রার্থীকে ভোট দেবেন না, কিন্তু এই যে ভোট দেবেন না, সেই বিকল্প প্রার্থী তাঁর সামনে নেই। জনগণের যে বিচারের ক্ষমতা ছিল, সেই বিচারের ক্ষমতা জনগণ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, সমাজে দুটো শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। এক শ্রেণি অতি সম্পদশালী, আরেক শ্রেণি দিন-আনে দিন খায়। অল্প কিছু লোকের আগ্রাসী সংস্কৃতির মধ্যে চলে গেছে দেশ। এটা বিপজ্জনক।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম প্রমুখ।