দুর্নীতির সূচকে এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন স্কোর হতাশাজনক : টিআইবি
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আরও অবনতি হয়েছে। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই)-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ এর তুলনায় ০-১০০ স্কেলে এক পয়েন্ট কমে ২৪ এবং নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে যথাক্রমে দশম ও ১৪৯তম। এ দিকে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক, দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড। আর দুর্নীতিগ্রস্তের শীর্ষে আছে ।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে আজ মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) এ তথ্য জানান সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, ‘সিপিআই অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যে আবর্তিত ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় আরও এক পয়েন্ট কমে এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৪ স্কোর এবং নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম উভয় দিক থেকেই দুই ধাপ অবনমন হয়ে যথাক্রমে ১০ম ও ১৪৯তম অবস্থানে রয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, টিআই কর্তৃক ২০১২ থেকে ২০২৩ মেয়াদের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের এ বারের স্কোর সার্বিক ১২ বছরের গড় স্কোর ২৬ এর তুলনায় দুই পয়েন্ট কম এবং এই মেয়াদে সর্বনিম্ন।
স্কোর ও অবস্থানের এই অবনমন ইঙ্গিত করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার সূচকের তথ্যের সময়কালে (নভেম্বর ২০২০- সেপ্টেম্বর ২০২৩) বাস্তবিক অর্থে কোনো কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। বরং, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরো অবনতি হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কার্যকরভাবে সব ধরনের দুর্নীতির অপরাধের শাস্তি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। সেখা জানানো হয়, ২০২৩ সালের সিপিআই অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক, ৮৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড। আর ১১ স্কোর পেয়ে ২০২৩ সালে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া।
১৩ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা এবং ১৬ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ইয়েমেন।
সংবাদ সম্মেলনে আারও জানানো হয়, সিপিআই-এ অন্তর্ভূক্ত ১৮০টির মধ্যে ১০৫টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর কম স্কোর করেছে। অর্থাৎ, বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই গড় স্কোর ৪৩-এর চেয়ে কম পেয়ে সূচকের শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে বাস করছে। আর সূচকে অন্তর্ভূক্ত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ১২২টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে, যার অর্থ এসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক।
এ বছর সিপিআইয়ের প্রতিপাদ্য ‘দুর্নীতি ও অবিচার’ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ড. জামান বলেন, ‘সিপিআই-এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯; অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪! এমনকি ফ্রিডম হাউজ অনুযায়ী যেসব দেশে নির্বাচনি গণতন্ত্র আছে এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনি গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রসমূহের গড় স্কোর ৩১- সেখানেও বাংলাদেশের ২৪ স্কোর, উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর। দুর্নীতি ও অবিচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; দুর্নীতি অন্যায়ের জন্ম দেয় এবং অন্যায় দুর্নীতির দুষ্ট চক্র তৈরি করে। সিপিআইয়ের তথ্য আরও প্রমাণ করে, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত, সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি।’
২০২৩ সালের সিপিআই অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ভুটান গত বছরের ৬৮ স্কোর ধরে রাখলেও, এ অঞ্চলের পাঁচটি দেশ এবার ২০২২ এর তুলনায় কম স্কোর করেছে। আর অবশিষ্ট দুটি দেশের স্কোর কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের চার পয়েন্ট, শ্রীলংকার দুই পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর এক পয়েন্ট করে কমেছে। আর পাকিস্তানের দুই পয়েন্ট এবং নেপালের এক পয়েন্ট স্কোর বেড়েছে। তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশই সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর কম পেয়েছে। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণ সার্বিকভাবে অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।