প্রতিক্রিয়া
বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে!
আজ পনেরো দিন! মেয়েটা ঘরে ফেরে না। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে তড়িঘড়ি করে মাকে ডেকে বলে না-খাওয়ার কী আছে মা? তাড়াতাড়ি দাও তো, ক্ষুধায় পেট ছিঁড়ে গেল! মা রেঁধে বসে থাকেন ঠিকই, মেয়ে ফেরে না। ফিরবে না আর কোনোদিন। কোনোদিনই না! আর একটা বর্ষা দেখবে না সোহাগী। বৃষ্টিদিনে দুই হাত প্রসারিত করে ভিজবে না তনু আর কোনোদিন। গাইবে না আর ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছি দান।’ আর কোনো আশ্বিনে-ভাদ্দরে দেখা মিলবে না তার। ফাগুনের মৌ জোৎস্না মাখবে না আর কোনোদিন। পৃথিবী উল্টে গেলেও না। সে এখন দূর অজানায় ভেসে বেড়ানো একলা পাখি। যে পাখিকে ক্ষতবিক্ষত করে চিরবিদায় দিয়েছে এই সমাজ। এই সমাজের মানুষ। এই সমাজের মানুষ নামের নরপশুরা!
যাওয়ার আগে মাকে বলে গেছিল- ‘মা, দর্জির দোকান থেকে আমার নতুন জামাটা আজ নিয়ে এসো, আমি কাল নতুন জামা পরে কলেজে যাব।’ মা নতুন জামাটা টেইলারের দোকান থেকে এনে রাখবেন হয়তো। শুধু সোহাগী আর ফিরবে না ঘরে। নতুন জামাটা পরে এদিক সেদিক ঘুরে মাকে দেখিয়ে বলবে না- দেখো তো মা, কেমন হয়েছে? ভালো লাগছে তো? সে এখন সব ভালো লাগা-মন্দ লাগার ঊর্ধ্বে।
সোহাগী গত হয়েছে আজ পনের দিন। দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত সেনানিবাসের ভেতরে ধর্ষিত হয়েছে মেয়েটা। লাশ হয়ে পড়ে থেকেছে পানির ট্যাংকের পাশের ঝোপের আড়ালে। কোথাও পড়েছে মাথার চুল, কোথাও গায়ের কাপড়, কোথাও উড়ে গিয়ে পড়েছে হাতের মোবাইলটা। আর বাকি জায়গায় পড়েছে রক্ত! সোহাগীর গায়ের তাজা রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে ঘাসেরা। সুরক্ষিত অঞ্চলের ঘাসেরাও বড় চুপচাপ। তারা দেখলেও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। রাত দশটা অবদি মেয়ের খোঁজ না পেয়ে বাবা খুঁজতে বের হন। দেখা মেলে মেয়ের। নিথর পড়ে আছে। হাউমাউ করে ডেকে ওঠেন বাবা- ‘মা, মা, মা আমার।’ একি হলো তোর! আমি কেন তোকে টিউশনিতে পাঠালাম! সব দোষ আমার! আমার কপালের! পারলে আমাকে ক্ষমা করিস!
সোহাগীর বাবা হয়তো বুক চাপড়ে নিজের কপালেই আঘাত করেন। নিজের দারিদ্র্যকে দোষ দেন। মেয়েকে টিউশনি করতে পাঠাতে হতো বলে সারা জীবনই দোষ দিয়ে যাবেন নিজেকে হয়তো। কিন্তু হওয়ার কথা কি ছিল এমন? ফুটফুটে একটি মেয়ে টিউশনিতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত লাশ হয়ে ফিরবে? সেনানিবাস সুরক্ষিত অঞ্চল!
এতই সুরক্ষিত অঞ্চল যে, কে বা কারা এই কুকর্মটি করেছে তার হদিস এখনো বের হয়নি। সকল তথ্য-আলামতও রয়েছে খুব গোপনে, খুব সুরক্ষিত। তার নাগাল পাওয়ার সাধ্য এখন পর্যন্ত কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়নি।
সোহাগী আবৃত্তি করত, নাচত, থিয়েটার করত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা সময় আমিও যুক্ত ছিলাম থিয়েটারে। একজন থিয়েটারকর্মী হিসেবে সোহাগী ছিল আমার সহকর্মী। দেশের সব থিয়েটারকর্মীকেই থিয়েটার যাঁরা করেন, তাঁরা সহকর্মী মনে করেন। সব সাংস্কৃতিককর্মীকেই মনে করেন সহযোদ্ধা। অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন থিয়েটারে হলেও নাটকের দলের সদস্য হিসেবে, সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমরা একই পথের পথিক ছিলাম। সেই পথ থেকে ছিটকে বাইরে ছুঁড়ে দেওয়া হলো সোহাগীকে।
নাটক যাঁরা করেন বা যারা খুব কাছ থেকে দেখেন, তাঁরা জানেন নাটক কতটা শ্রম ও ঘামের ফসল। কত পরিশ্রমে, কত দিন-রাত খাটাখাটনির পর মঞ্চে ওঠে একেকটি নাটক। কী উদ্দেশ্যে ওঠে? যাঁরা কাজকর্ম, লেখাপড়া ফেলে নাটকের পেছনে ছোটেন তাঁদের উদ্দেশ্য কী? এ দেশে মঞ্চনাটক করে টাকা কামানো যায়? যায় না! তবে অদ্ভুত এক মোহ নাটকের কর্মীদের টানে। দিনবদলের মোহ। সমাজটাকে বদলে দেওয়ার মোহ। নাটকের মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে আরেকটু জনমানুষের কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টা। তাদের খুব কাছে মিশে গিয়ে তাদের ভেতর থেকেই বোধের জায়গায় একটু নাড়া দেওয়া। খুব অবচেতনে জানিয়ে দেওয়া- জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়!
খুব মহৎ কাজ হয়তো নয়। কিংবা হতেও পারে। নাটকের দলের ছেলেমেয়েরা, সংস্কৃতিকর্মীরা মনের ভেতরে সেই স্বপ্নটুকু লালন করেই ঘাম ঝরায়। ঘুণে ধরা সমাজটায় পরিবর্তন চায় যারা, সেই পরিবর্তনের যোদ্ধাকেই আমরা শেষ করে দিয়েছি।
আজ পনোরোটি দিন গত হয়, এখনো কোনো কূলকিনারা বের করতে পারেনি। কোনো অপরাধী ধরা পড়েনি। কোনো উদ্যোগ কার্যত দেখা যায়নি কিছু ছেলেভোলানো আশার বাণী ছাড়া। যে দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে ঘণ্টা সময় গত হওয়ার আগেই পুলিশ এসে হড়হড় করে টেনে নিয়ে যায়, সেই দেশে, সেই স্বাধীন সার্বভৌম মধ্যম আয়ের দেশে, সেনানিবাসের সুরক্ষিত অঞ্চলের ভেতরে এক স্বপ্নচারি থিয়েটারকর্মী, টিউশনি করে খরচ জোগানো এক শিক্ষার্থী, দিনবদলের যোদ্ধা ধর্ষিত হয়ে খুন হয়, পনেরো দিন যায়, পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। অপরাধীর টিকিটিও খুঁজে পায় না। খোঁজার ইচ্ছা আসলে আছে তো? আক্ষেপটা এখানেই!
লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে অর্জিত হয়েছে এই দেশ। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও নিদারুণ সত্য এই যে, এই দেশে এখনো মা-বোনেরা ঠিক পাক হানাদারি কায়দায় ধর্ষিত হয়, খুন হয় একই কায়দায়। রাস্তাঘাটে, স্কুলে, কলেজে, অফিসে, বাড়িতে, গাড়িতে কোথাও আজও গড়ে ওঠেনি তিল পরিমাণ নিরাপত্তা। হানাদারদের প্রেতাত্মারা যেন আজও ঘুরে বেড়ায় মানুষরূপে। তারা আর কেউ নয়, আমাদেরই পাশের কেউ এক বা একাধিকজন। যেই লোকটিকে ভাই বলে ডাকি আমরা, যে কারো বাবা, কারো মামা, কারো চাচা তারাই। মানুষের সঙ্গেই বসবাস করা মানুষরূপী জানোয়ার, তারাই। সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে সেই পুরোনো কায়দায়! ওদিকে বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে। সে কান্না শোনার লোক এই বঙ্গভূমে নেই!
এরই মধ্যে সেদিন দুই বোনকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করা হলো। পাবনায় গণধর্ষণের শিকার হলেন এক নারী। টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হলো এক গৃহবধূকে। এ ধর্ষণের লাগাম যেন টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। টানছে না কেউ। সবাই যেন নীরব দর্শক।
ধর্ষণ করে, খুন করে, লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলেও অপরাধী ধরা পড়ে না। পড়লেও তার বিচার হয় না। হলেও সে বিচার হতে হতে কেটে যায় যুগের পর যুগ। দৃষ্টান্তমূলক কোনো সাজার নজির স্থাপিত হয় না। ঘৃণ্য অপরাধীরা আরো দূরন্ত হয়ে ওঠে। বিচার নেই দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার-আপনারই বোনের ওপর, মেয়ের ওপর, স্ত্রীর ওপর। আমরা চুপচাপ! নীরব দর্শক যেন! আর কতদিন?
নিজেদের নিরাপদ ভেবে বসে আছেন? এখনই এসব ঘৃণ্য, জঘণ্য পশুদের প্রতিরোধ করতে না পারলে খুব বেশিদিন দূরে নয়, যেদিন ওরা এসে বাড়ি বাড়ি থেকে চোখের সামনে আপনারই মেয়েকে, বোনকে তুলে নিয়ে যাবে। এখনো যে নিয়ে যাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তরুণ সমাজ জেগেছে এরই মধ্যে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা উত্তাল হয়েছে আন্দোলনে। আপনিও জাগুন। সময় থাকতে আওয়াজ তুলুন। বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হোন। এ রাষ্ট্র আমাদের এমনি এমনি কিছু দেবে না। আদায় করে নিতে হবে। পেটের ভাত থেকে আইনের বিচার, সবই নিতে হবে আদায় করে।
সোহাগীর হত্যাকারীসহ সব খুনি-ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশ্য বিচার চাই।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ