জন্মদিন
মার্লোন ব্র্যান্ডোর প্রতিবাদী স্বর
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য একটি লিখিত বক্তব্য প্রস্তুত করেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডো। বক্তব্যের বিষয়- কেন তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করছেন। ১৯৭৩ সালে ‘দ্য গডফাদার’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের সুবাদেই অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, যা তিনি বর্জন করেন আমেরিকান ইন্ডিয়ানদেরকে নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে। তবে বক্তব্যটি নিজে অস্কারের মঞ্চে পড়ে শোনাননি ব্র্যান্ডো, এমনকি তিনি নিজে উপস্থিতও ছিলেন না সেই পুরস্কার বিতরণী সন্ধ্যায়। তাঁর পক্ষে সেই বক্তব্যের বিষয়টি অনুষ্ঠানে আসা সবার সামনে তুলে ধরেন অভিনেত্রী ও আদিবাসী আমেরিকানদের স্বাধিকার আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী সাশিন লিটলফেদার। পরে এই বক্তব্যের পুরোটাই সাশিন সাংবাদিকদের দিয়ে দেন।
কিংবদন্তি অভিনেতা ব্র্যান্ডোর ৯২তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই বক্তব্যের পুরোটাই অনুবাদ করে দেওয়া হলো পাঠকের জন্য। বক্তব্যটি নেওয়া হয়েছে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে’র অনলাইন সংস্করণ থেকে। অস্কার মঞ্চে সাশিন লিটলফেদারের দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণটির ভিডিও লিংকও দেওয়া হলো এখানে।
দুশো বছর ধরে আমরা ইন্ডিয়ান মানুষদের উদ্দেশে কিছু কথা বলে আসছি। কথাগুলো এমন—‘বন্ধুরা, তোমরা যদি তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ করো, তবেই আমরা একসঙ্গে চলতে পারব। কেবল যদি তোমরা, বন্ধুগণ, তোমাদের অস্ত্র চালানো বন্ধ করো, তাহলেই আমরা শান্তির বিষয়ে আলাপ করতে পারব। আর সেটা তোমাদের জন্যই ভালো হবে।’ এই মানুষগুলো লড়াই করছে তাদের আদিভূমির জন্য, জীবনের জন্য, পরিবারের জন্য এবং অবশ্যই তাদের ন্যায্য স্বাধীনতার জন্য।
যখন তারা অস্ত্র সমর্পণ করল, আমরা তাদের হত্যা করলাম। আমরা ওদের মিথ্যে বলেছিলাম। ওদের নিজভূমির নামে ওদের ধোঁকা দিলাম। চুক্তি নামের জালিয়াতি এমন কিছু মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ওদের দিলাম, যা আমরা কোনোদিনই রক্ষা করিনি। আমরা ওদের ভিখারিতে পরিণত করলাম। ইতিহাসকে যেমন করেই ঘুরিয়ে দেওয়া হোক না কেন—আমরা কাজটি ভালো করিনি। আমরা যে কাজটি করেছি তা অনৈতিক। ওদের জীবন গুছিয়ে দেওয়া যেমন আমাদের কাজ নয়, তেমনি আমাদের প্রতিশ্রুতি পালন করারও কোনো দায় নেই! কারণ আমাদের তো ক্ষমতা রয়েছে, অন্যের অধিকারে আঘাত হানবার, অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার, যখন তারা জীবন আর নিজেদের আদিভূমি বাঁচানোর চেষ্টা করছে তখন তাদের হত্যা করার। আর হ্যাঁ, সেই সঙ্গে তাদের সৎকর্মকে অপরাধ আর আমাদের অপরাধকে সৎকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাঁয়তারা তো রয়েছেই!
তবে একটা বিষয় রয়েছে যা এই জঘন্য আচরণের আওতার বাইরে, আর সেটা ইতিহাসের রায়। আর ইতিহাস নিঃসন্দেহেই আমাদের বিচার করবে, নির্মমভাবে। তাতে কি আমাদের কিছু যায়-আসে? আমাদের নৈতিক দ্বিচারিতার এ এক চরম নিদর্শন, অথচ আমরা গলা উঁচিয়ে আস্ফালন করছি আর পুরো দুনিয়াকে বলে বেড়াচ্ছি যে আমরা সব সময় কথা রাখি, প্রতিজ্ঞা পালন করি! ইতিহাসের প্রত্যেক পাতা আর আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের গত একশো বছরের প্রতিটি ক্ষুধার্ত, অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত আর লাঞ্ছিত দিনরাত্রি তো এই এই হীন দাবিকে অস্বীকার করবে।
ন্যায়নীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং প্রতিবেশীদের ভালোবাসার বিষয়টি আমাদের ক্ষেত্রে অকার্যকর, সেটা দেখাই যাচ্ছে। আমরা এখনো পর্যন্ত যা করেছি, আমাদের অভিসন্ধি পূরণ করতে আমাদের ক্ষমতাকে যেভাবে ব্যবহার করেছি— তার নিদর্শন পৃথিবীর যে কোনো নবজন্মা রাষ্ট্রের প্রত্যাশাকে অঙ্কুরে নষ্ট করে দেবে। বন্ধুর কাছে হোক আর শত্রুর কাছে— আমাদের পরিচয় এখন এমনই, আমরা আসলে মানুষেরই যোগ্য নই, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই, আর আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পালন করি না, রক্ষা করি না।
আপনি হয়তো এখন নিজেকে আনমনে বলছেন, ‘এসব অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা এই অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বলার মানেটা কী? এই মহিলা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন, আমাদের এই চমৎকার সন্ধ্যেটাই বা মাটি করে দিচ্ছে কেন, এমন কিছু জিনিস নিয়ে আমাদের বলছে কেন যেটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা বা সম্পৃক্ততা নেই, আর যেটার পরোয়া আমরা করি না? শুধু শুধু আমাদের সময় আর অর্থ অপচয় করছে, তাও আবার আমাদের ঘরে ঢুকে!’
এই না বলা প্রশ্নগুলোর জন্য আমার কাছে উত্তরটা হলো এমন, চলচ্চিত্র জগৎ ইন্ডিয়ানদের ছোট করে আর খেলো করে দেখানোর দায়ভার গ্রহণ করতে বাধ্য। ইন্ডিয়ানদের হিংস্র, জংলি আর বর্বর হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে এটি। এই পৃথিবীটা শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য বড় কঠিন এক জায়গা। ইন্ডিয়ান শিশুরা যখন টেলিভিশন দেখে, কিংবা সিনেমা দেখে, তারা দেখতে পায়—তাদেরকে এক রকম বিকৃত আর ভয়াবহভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, আর এটা তাদের মনমানসিকতাকে যে কতটা আহত আর ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা আমাদের পক্ষে কখনোই অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতির সমাধানের জন্য সম্প্রতি সামান্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো খুবই সামান্য আর শ্লথ। চলচ্চিত্রের একজন পেশাদারি মানুষ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আজকের রাতে আমার পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমি মনে করি, এই দেশে এখন কোনো পুরস্কারই দেওয়া বা নেওয়া একেবারেই প্রযোজ্য নয়, যতদিন না আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের এই পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলানো যাচ্ছে। আমরা আমাদের ভাইকে রক্ষা করতে না পারি, কিন্তু তাদের হত্যাকারীর ভূমিকায় যেন না নামি!
আজ আমি হয়তো এই কথাগুলো বলার জন্য সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারতাম। তবে আমার মনে হয়েছে, আমি উন্ডেড নি’তে (সাউথ ডাকোটার উন্ডেড নি ক্রিক, তথা উন্ডেড নি ম্যাসাকারের কথা বলা হচ্ছে) কাউকে সেবার জন্য থাকলেই ভালো করব। এর বদলে কোনো জায়গায় গিয়ে শান্তি স্থাপনের এসব কথা আমি বলতে গেলে সেটা হবে অসম্মানের।
যাঁরা শুনছেন, তাঁরা আশা করি কথাগুলোকে রূঢ়ভাবে নেবেন না, তবে এই বিষয়টির দিকে মনোযোগ আকর্ষণের একটি সৎ প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করবেন। এটিই নির্ধারণ করে দেবে যে আমরা মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার আর নিজেদের মাটিতে বসবাসের অধিকারকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিশ্বাস করি কি না।
আপনারা এতক্ষণ কথাগুলো শুনেছেন, ধন্যবাদ। মিস লিটলফেদারের প্রতিও আপনারা যে ভদ্রতা দেখিয়েছেন, তার জন্যও আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ এবং শুভরাত্রি।