পাহাড়েও বেনজীরের থাবা, গড়েছেন বাংলো-গরু-মাছের খামার
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে বান্দরবানে দুটি উপজেলায় রয়েছে প্রায় একশ একর পাহাড়ি জমি। জেলার সদর উপজেলার সুয়ালক এলাকায় রয়েছে পঁচিশ একরের জমিতে মাছ ও গরুর খামার। এ ছাড়াও রয়েছে অবকাশযাপনে বাংলো এবং লামার ডলুছড়িতে পঞ্চান্ন একরের জমিতে ফলদ-বনজ বাগান। স্থানীয়দের কাছে জায়গাগুলো আইজিপির জমি নামে পরিচিত।
আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আরও বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার আদালতের আদেশে বান্দরবানে ৭৫ বিঘাসহ এসব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসহায় গরীব মানুষজনদের নামমাত্র মূল্যে জমিগুলো বিক্রি করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। জমিগুলো নামমাত্র দামে কিনে দখল করে নিতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা এবং দুটি মৌজার হেডম্যান। পর্দার আড়ালে থেকে এসব জমিতে যাওয়ার সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা।
স্থানীয়রা জানায়, ২০১৬ সালে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে সূয়ালক ইউনিয়নের ৩১৪ নম্বর সূয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগে ও তিন নম্বর শিটে ২৫ একর জায়গা লিজ নেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, লিজ নেওয়া পঁচিশ একর জায়গা জুড়ে মাছ ও গরুর খামার এবং পাহাড়ে অবকাশযাপনের জন্য দোতলা একটি বাংলো বাড়িও তৈরি করেন বেনজীর। খামারে বিক্রিযোগ্য ৩৫টি গরুও রয়েছে। সবচেয়ে বড় গরুটির দাম আড়াই লাখ টাকা বলেও জানিয়েছেন খামারের কর্মচারী।
এ দিকে খামারে যেতে সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা, দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বাংলোতে রয়েছে এসিও। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা খামারের চারপাশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জাতের ফলদ ও বনজ গাছ। বাগানের প্রবেশমুখে তালাবদ্ধ আকর্ষণীয় গেট।
অপরদিকে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে বেনজীর পরিবারের নামে রয়েছে ৫৫ একর পাহাড়ি জমি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন ধরনের মিশ্র ফলের ও বনজ গাছের বাগান। সেখানেও তৈরি করেছেন একটি বাংলো। গোটা জায়গাগুলো ঘুরতে লেগে যায় পুরোটা দিন।
বেনজীরের খামারে দায়িত্বে নিয়োজিত নজুম উদ্দিন, লেদু মিয়া বলেন, খামারসহ এই জায়গাটির সবকিছু দেখাশোনা করেন মূলত মং ওয়াইচিং দাদা। তিনি বান্দরবান জেলা সদরের মধ্যমপাড়াতে থাকেন। তবে এই জায়গাটির মালিক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ। খামারে বর্তমানে বাচ্চাসহ ৩৭টি গরু রয়েছে। বাজারে বিক্রয়যোগ্য গরু রয়েছে ৩৫টি। সবচেয়ে বড় গরুটি দাম পড়বে কম হলেও আড়াই লাখ টাকা।
এদিকে ডলুছড়ি মৌজার টংগঝিরিতে একটা সময়ে অসহায় ও গরিব অনেকগুলো পরিবারের বসতি ছিল। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনজীর আহমেদ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় নামমাত্র মূল্যে ৫৫ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন। অথচ অসহায় পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ও আয়ের উৎস ছিল এসব জমি।
ডলুছড়ি মৌজার অজিত ত্রিপুরা বলেন, ‘জায়গাগুলো যখন দখল করে নিচ্ছিল তখন আমিও হলেও বুঝতে পারতাম। তখন দেখেছি মং ওয়াইচিং এসে আমার বাবার কাছে এক লাখ টাকা দিয়ে জোর করে পাঁচ একর জায়গা লিখে নিয়েছে। একইভাবে অন্যদের জায়গাও নিয়ে নিয়েছে। তখন কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে লামা ও বান্দরবান থেকে পুলিশের লোকজন গিয়ে নানাভাবে হয়রানি করত। এতদিন ভয়ে কথাগুলো কাউকে ঠিকমত বলতে পারিনি। কিন্তু পাহাড়ি নেতারা জানত, তারা অসহায় ছিল।’
ডলুছড়ি মৌজার সাবেক মেম্বার ফাইসা প্রু বলেন, আমার এলাকায় বেনজীর আহমেদের পরিবারের ৫৫ একর পাহাড়ি জমি রয়েছে। জমিগুলোতে একটা সময়ে অসহায় অনেকগুলো পরিবারের বসবাস থাকলেও বর্তমানে গোটা জায়গাটি সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার দখলে। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আত্মীয় আওয়ামী লীগনেতা মং ওয়াইচিং জায়গাগুলো পুলিশ প্রধানকে নিয়ে দিয়েছিল। বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ধরনের কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিল।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং বলেন, ‘সূয়ালকের মাঝেরপাড়ায় বেনজীর আহমেদের জমির পাশে আমার কিছু জমি রয়েছে। সেই সুবাদে একদিন এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আমাকে বেনজীর আহমেদের জায়গাগুলো দেখাশুনা করতে বলেন। আমি তাদের জমিগুলো দেখাশোনা করতাম। কিন্তু লামার ডলুছড়ির টংগঝিরি এলাকায় জায়গা দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই।’
এ প্রসঙ্গো বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, বেনজীর আহমেদের নামে বান্দরবান লিজের জায়গা বা জোর করে জায়গা দখল করেছেন এমন কিছু জানা নেই। তথ্যটি সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।’
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন আরও জানান, বেনজীরের সম্পদ জব্দের আদালতের আদেশের কপি এখনো হাতে আসেনি। আদালতে কপি পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদেশে কি লেখা আছে, সেটি না জেনে কীভাবে পদক্ষেপ নেব।
বান্দরবানের সূয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা জানান, বেনজীরের সম্পদ জব্দের জন্য আদালত আদেশ দিয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু জেলা প্রশাসকের কোনো চিঠি আমরা এখনও পাইনি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা পেলে আইনগতভাবে সবধরনের সহযোগিতা করা হবে।