‘কী নিয়ে বাঁচব আমি’
রিয়া গোপ। সাড়ে ছয় বছরের ফুটফুটে ছোট্ট শিশু। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে। ঘরের বাইরে তার খেলার জায়গা বলতে ছিল বাড়ির ছাদ। এ বছরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। তার বাবার প্রশ্ন, ‘কী নিয়ে বাঁচব আমি?’
প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবার দুপুরের খাবার খেয়ে ছাদে খেলতে যায় রিয়া। হঠাৎ ভবনের নিচে ও চারপাশে হইচই, চিৎকার চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ। তাকে ঘরে আনতে দৌড়ে ছাদে যান বাবা দীপুক কুমার গোপ। মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই এক বুলেট এসে বিদ্ধ হয় শিশু রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই ফুটফুটে ছোট্ট দেহটি ঢলে পড়ে বাবার কোলে। রক্তে ভিজে যায় বাবা দীপকের শরীর।
দ্রুত রিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে। চিকিৎসক অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। রাতেই তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়। সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে আশ্বস্ত করেন চিকিৎসকরা। তাকে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। বলা হয়, ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। অস্ত্রোপচারের পর শনিবার পার হয়। রোববার ও সোমবার আইসিইউতে একটু একটু করে আঙুল নাড়ছিল সে। এতে স্বজনদের বুকে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু গতকাল বুধবার (২৪ জুলাই) সকালে রিয়ার সেই নড়াচড়াও থেমে যায়। সবাইকে কাঁদিয়ে সে চলে যায় না ফেরার দেশে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিয়ার মৃত্যুর কারণ লেখা হয়, ‘গানশট ইনজুরি’।
রিয়ার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় গতকাল বুধবার সন্ধ্যার দিকে। মর্গ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্ট্রেচারে রাখা মেয়েটির মুখ দেখানো হয় স্বজনদের। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। পরে গতকাল রাতেই শহরের মাসদাইর শ্মশানে রিয়ার সৎকার করা হয়।
রিয়ার ছোট খালা আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমার ছোট মারে, তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলি! তোরে ছাড়া আমরা কেমনে বাঁচব?’
হোশিয়ারি ব্যবসাকেন্দ্র শহরের নয়ামাটি এলাকায় পাঁচতলা দ্বীনবন্ধু মার্কেটের পঞ্চম তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন দীপুক কুমার গোপ। দীপক কুমার গোপ-বিউটি দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। অনেক সাধনার পর বিয়ের পাঁচ বছর পর এ দম্পতির ঘর আলো করে আসে সে। দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর।
স্থানীয়রা জানায়, বাড়ির তিন দিকে বিল্ডিং। শুধু পশ্চিম দিকে খোলা। ফলে ছাদ থেকে ডিআইটি এলাকায় গুলশান সিনেমাহল দেখা যায়। ওই খান থেকেই গুলি এসে শিশু রিয়ার মাথায় বিদ্ধ হয়।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিন দ্বীনবন্ধু মার্কেটে তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায় রিয়াদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার স্টিলের গেট ভেতর থেকে বন্ধ। পুরো মার্কেটজুড়ে সুনশান নীরবতা। স্তব্দ রিয়ার পরিবার। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েও গেট খুলতে রাজি হননি দীপক কুমার গোপ। ভেতর থেকে কেউ একজন বলেন, ‘লিখে আর কী হবে! সব তো শেষ! আমরা কথা বলব না।’
পরিবারের সদস্যদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, শুক্রবার মেয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা বিউটি। তাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আজ দুপুরেও তাঁকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
অবশেষে দীপক কুমারের সঙ্গে কথা হলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি কী নিয়ে বাঁচব?’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।