গল্প
বেলি ফুলের মা
বাড়ির পেছনে অগোছালো ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড়ই বলতে হবে, বাগান বলার কোনো উপায় নেই। বাগান সাজানো-গোছানো হয়, কেউ যত্ন নেয়। কিন্তু এই গাছগুলো, ঘাসগুলোর যত্ন কেউ নেয় না। কেউ ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না। যে গাছের যেখান থেকে ইচ্ছে সে সেখান থেকে গজিয়েছে। কেউ ওদের জন্য কোনো নিয়ম বেঁধে দেয়নি।
এই ঝোপঝাড়েই একটা বকুল গাছ থাকে। তার গোড়ায় একটা বেলির ঝোপ। বকুলের ছায়ায় বড় হচ্ছে বেলিটা। খুব চঞ্চল সে। দূর্বা আর ঘাসফুলের সঙ্গে তার ভারি বন্ধুত্ব। সারাদিন তাদের সঙ্গে গল্পে মেতে থাকে। বকুল গাছটা তার মায়ের মতো। মাকে কখনো দেখেনি সে। বকুল মায়ের কাছেই শুনেছে তার মায়ের গল্প। তার মা নাকি খুব সুন্দর ছিল। তার উজ্জ্বল সবুজ পাতা ছিল। সারা বছর তার গায়ে ফুটে থাকত স্নিগ্ধ বেলি। বর্ষা এলে নাকি মা অপরূপা সুন্দরী হয়ে উঠত। তার গা থেকে মিষ্টি সুবাস ছড়াত, তার শরীর ঢেকে থাকত সাদা ফুলের আভরণে।
মায়ের গল্প শুনতে শুনতে মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হয় বেলিগাছটার। কিন্তু মা নেই। কোথাও নেই। ঝোপে নেই, ঝাড়ে নেই, আকাশে নেই, বাতাসে নেই- কোথাও নেই। বকুল মা বলেছে, গেল বৈশাখে নাকি তীব্র রোদ ছিল। কয়েকদিন টানা রোদ শুধু। কোনো বৃষ্টি হয়নি। এত রোদে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পানি না পেয়ে সে খাবার রাঁধতে পারছিল না, খেতেও পারছিল না। তার উজ্জ্বল পাতাগুলো হলুদ হয়ে আসছিল। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। কিন্তু কেউ তাকে পানি দিতে আসেনি। বাড়ির কোনো লোক তো কখনো এ পাশটায় তাকিয়েই দেখে না! পানি না পেয়ে মা আরো বেশি অসুস্থ হতে থাকে, ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। এরপর এক ঝলমলে সকালে আকাশে জড়ো হয় অনেক কালো মেঘ। একটু পর মেঘ গুড়গুড় করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। তখন মা নাকি কাতর গলায় বলছিল, ‘কেউ একটু পানি দেবে? একটু পানি?’
ঠিক তখন বৃষ্টি নামে। মায়ের শরীর ভেজে স্বস্তির বৃষ্টিতে। মা প্রশান্তিতে পানি পান করেছিল। এরপর আস্তে আস্তে চিরদিনের মতো চোখ বুজে ফেলেছিল। আর কখনো ফিরে আসেনি। কখনো ফিরে আসবে না।
বেলির মা আর বকুল খুব ভালো বন্ধু ছিল। বেলি বকুল মায়ের কাছে শুনেছে, মা নাকি বকুল মাকে বলে গিয়েছিল তাকে দেখে রাখতে। বলেছিল, ‘আমার মেয়ে যেন কখনো আমার মতো পানি না পেয়ে অসুস্থ না হয়। তুই আমার মেয়েকে দেখিস। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না, একদম কষ্ট পেতে দিস না।’
বেলি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা যদি পানি না পেয়ে মারা যায়, তবে আমি কেন মরে গেলাম না? তুমি কেন মরে গেলে না?’
বকুল বলেছে, ‘আমি তো অনেক বড়। তাই আমি কষ্টটা সহ্য করতে পেরেছি। আর তোর তো তখনও জন্মই হয়নি। তোর মায়ের মৃত্যুর পর তার শেকড় থেকে তুই হয়েছিস।’
বেলিগাছটা মাত্র বড় হচ্ছে। তার শরীর থেকে যখন একটা একটা করে ডাল বেরোয়, আর ডালগুলো থেকে কোঁকড়ানো ছোট্ট পাতা বেরোয়, তার কী যে আনন্দ হয় সেই কথা আর বলার না! সে শুধুই অপেক্ষা করে থাকে, একদিন তার এই ডাল থেকে ছোট্ট ছোট্ট হালকা সবুজ কুঁড়ি বেরুবে, সেই কুড়ি আস্তে আস্তে বড় হবে, ধবধবে সাদা রং হবে। এরপর কোনো এক সন্ধ্যায় সারা পৃথিবীকে সুবাসিত করে কুঁড়িটা ফুল হয়ে ফুটবে।
এক বৈশাখ পেরিয়ে আরেক বৈশাখ এসেছে। মা বেলির মৃত্যুর পর এক বছর কেটে গেছে। কয়েকদিন ধরে গরমটা খুব বেড়েছে। সপ্তাহখানেক আগেও ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বেলি সেদিন খুব নেচেছে, মনের আনন্দে গান গেয়েছে। কিন্তু এই সপ্তাহে বৃষ্টির নামটিও নেই। শুধু রোদ আর রোদ। বকুল মাকে কীসের যেন চিন্তায় পেয়ে বসেছে। সে কথা বলে না মোটে; যা দুয়েকটা কথা বলে, তার কেমন যেন গলাটা ধরে আসে। কী হয়েছে বেলি বুঝতে পারছে না। এই কয়েকদিন ধরে তার শরীরটাও ভালো নেই। গা-টা কেমন গরম গরম লাগে, শরীর ম্যাজম্যাজ করে। কিছুদিন হলো তার পাতাগুলোও আর আগের মতো সতেজ নেই। কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। খাবার বানাতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। বেলি বকুলকে এসব কথা বলেছে। বকুল কিছু বলেনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে শুধু।
কাল রাত থেকে বেলির খুব কষ্ট হচ্ছে, শ্বাসকষ্ট। বকুল বাতাসকে ডেকে বেলিকে একটু ছুঁয়ে দিতে বলল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘শোন বেলি মা, আজ তোকে একটা কথা বলি। গত বৈশাখেও ঠিক এমন গরম ছিল। কয়েকদিন বৃষ্টি হয়নি। আর এমন গরমেই পানির অভাবে তোর মা মারা গিয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল তোকে দেখে রাখতে। তার শেষ ইচ্ছে ছিল তুই সুস্থভাবে বেঁচে থাক। তোকে যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে মা, তোর মায়ের জন্য।’
বেলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘আমি কী করে বাঁচব বকুল মা?’
বকুল বলল, ‘তুই কিছু একটা উপায় বের কর মা।’
বেলি সেদিন থেকে খুব কষ্ট করতে শুরু করল। একটা ফুল ফোটানোর জন্য তার এত কষ্ট। তার শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে আসছে, সেই হার জিরজিরে ফ্যাকাশে ডালে এক থোকা কুঁড়ি এসেছে। কুঁড়িগুলো ফ্যাকাশে, কিন্তু তা দেখে বেলির কী আনন্দ! সে খুব কষ্ট করে খাবার রাঁধে, কুঁড়িদের খাওয়ায়, আস্তে আস্তে তাদের বড় করে। এখন কুঁড়িগুলো পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফুটতেই বাকি শুধু।
সন্ধ্যা থেকে গরম বেড়েছে খুব। বেলি শ্বাস নিতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। সে বার বার কান্নাভেজা দৃষ্টিতে তার গায়ের কুঁড়ির থোকার দিকে তাকাচ্ছে। স্নিগ্ধ সাদা ডাগর ডাগর কুঁড়িগুলো পাপড়ি মেলে পৃথিবীকে দেখার অপেক্ষায় এখন। বেলির যেভাবে শরীর খারাপ হচ্ছে তাতে কুঁড়িগুলোকে কীভাবে ফোটাবে সে বুঝতে পারছে না। বকুল মা খুব কাঁদছে। বেলির কাছে সবকিছুই কেমন অস্পষ্ট লাগছে। গনগনে গরম বাতাস, বকুলের ছায়া- সব কেমন ঝাপসা। বেলি বুঝতে পারছে সে মারা যাচ্ছে। মৃত্যু বুঝি এমন হয়? মায়েরও বুঝি এমন হয়েছিল? আচ্ছা, সে কি তবে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে? মুহূর্তেই বেলির বেশ মন ভালো হয়ে গেল। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, মা চেয়েছিল সে বেঁচে থাকুক। ওটাই ছিল মায়ের শেষ ইচ্ছে। বেলি তার সর্বশক্তি দিয়ে কুঁড়িগুলোকে ফোটাতে চেষ্টা করল। এরপর সে জ্ঞান হারাল।
সকাল হলো বেলির গন্ধ গায়ে মেখে। এমন গন্ধ কেউ কখনো পায়নি। বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়েটা গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পেছনের ঝোপে চলে এলো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল ফ্যাকাশে অর্ধমৃত একটা বেলিগাছ, যার শরীরজুড়ে ফুটে আছে মুক্তোর মতো ফুল। মেয়েটা যত্ন করে বেলিটাকে পানি দিল। তার শেকড়ের পাশের মাটি আলগা করে দিল। প্রতিদিন মেয়েটার যত্নে আস্তে আস্তে বেলি সুস্থ হয়ে উঠল। প্রতিদিন তার শরীরজুড়ে ফুটতে লাগল বেলি ফুলের মুক্তো।
এখন আর বাড়ির পেছনের জায়গাটাকে ঝোপ বলা চলে না। ছোট মেয়েটা ঝোপটাকে খুঁজে পাওয়ার পর যত্ন-আত্তি, ভালোবাসা দিয়ে এটাকে বাগান বানিয়ে ফেলেছে। সে বাগানে দূর্বা আছে, গাঁদা আছে, ঘাসফুল আছে। সেখানে বকুল আছে, বেলি আছে আর আছে এক পৃথিবী ভালোবাসা। মায়ের প্রতি বেলির ভালোবাসা, বেলির প্রতি তার মায়ের ভালোবাসা।