বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট, সপ্তাহজুড়ে উত্তাপ খোলা তেলে
সয়াবিনের দাম নিজেরাই বাড়িয়ে ফেলেছেন বিক্রেতারা, এমন অভিযোগ ক্রেতাদের। আবার বাজার ঘুরেও মেলে অভিযোগের প্রমাণ। কারণ, কোথাও মিলছে না সরকার নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল, উপরন্তু বোতলজাত তেলের তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট। গায়ের দামে বিক্রির পরিবর্তে খুলে বিক্রি করলে লাভ বেশি হচ্ছে–এজন্যই নাকি বোতল খুলে ‘সিন্ডিকেট নির্ধারিত’ দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। তবে, সেই সিন্ডিকেট কারা, মুখ খুলতে নারাজ বিক্রেতারা।
তেলের কৃত্রিম সংকট
আজ দুপুরের দিকে হঠাৎই চাউর হয়, বাজারে মিলছে না সয়াবিন তেল। এর প্রভাব পড়ে রাজধানীর অলিগলিতেও। কোনো কোনো এলাকায় বিক্রেতারা সয়াবিন তেল বিক্রির সঙ্গে আরও কিছু পণ্য নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেন। যদিও বিকেল নাগাদ সেই ঘোলাটে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে জানান বিক্রেতা ও ক্রেতারা। তবে, গত এক সপ্তাহ ধরে সংকট ছিল, যা এখনও আছে বলে জানান তারা।
আজ শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর, ঝিকাতলা, ধানমণ্ডি, মানিকনগর, রামপুরা, টিকাটুলি, শনিরআখড়া, আজিমপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারের মুদি দোকান ও সুপারশপে গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়।
এরইমধ্যে খবর আসে, রাজধানীর বাজারগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ের মূল্য ঘষে উঠিয়ে ফেলে বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও খবর নিয়ে জানা যায়, এটি কয়েকটি এলাকায় কয়েকটি দোকানের ঘটনা।
আমাদের এনটিভি অনলাইন টিম ঝিগাতলার বায়তুস সালাম আবাসিক এলাকায় গেলে শাহিন নামে এক মুদি দোকানি জানান, কয়েকদিন ধরে তার এলাকায় সয়াবিন তেলের গাড়ি আসছে না। এজন্য তার দোকানে তেল নেই।
শনিরআখড়ার বাজারে দুপুরের দিকে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক দোকানেই সয়াবিন তেল নেই বলে, ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া এই বাজারে অনেক দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তাদের ভেতরের র্যাকে তেল রাখার জায়গাগুলোও ফাঁকা। সয়াবিন তেলের তুলনায় বেশি রয়েছে সূর্যমুখী ও রাইস ব্র্যান তেল (চালের কুড়ার তেল)।
কাওসার নামের এক ক্রেতা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ঢাকায় ছোট পরিবার নিয়ে থাকেন। দুই মাস আগে পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল কিনেছেন। আজ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন কিনতে তিনি বাজারে এসেছিলেন। তবে বাজারে কোথায় সয়াবিন তেল না পাওয়ায় ফিরে গেছেন।
আবুল কালাম আজাদ নামের আরেক ক্রেতা রায়সাহেব বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসেন। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এক দোকানে পেয়েছি। কিন্তু সেখানে বলে—শুধু সয়াবিন তেল বিক্রি করবে না। তার দোকান থেকে অন্য বাজার কিনতে হবে। আমি শুধু সয়াবিন তেল নেব, কিন্তু বাধ্য করা হচ্ছে অন্য পণ্য কেনার জন্য। এভাবে মধ্যবিত্তদের বিপদে ফেলছেন দোকানি ও ব্যবসায়ীরা।
যা বলছেন দোকানিরা
দোকানদাররা বলছেন, সাপ্লাই নেই। হয়তো দাম বাড়াবে বলে কোম্পানিগুলো সাপ্লাই বন্ধ রেখেছে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে এটাই ধারণা করতে পারি।
‘সেলিম জেনারেল স্টোর’ নামে আরেক দোকানের বিক্রেতা মো. সেলিম বলেন, ‘আমার কাছে সয়াবিন তেল নেই। যা ছিল বিক্রি করে দিয়েছি। কোম্পানির থেকে সয়াবিন তেল নিলে তাদের পোলাওয়ের চাল নিতে হয়। সব কোম্পানিই এটা করছে। আমি দুই কার্টন তেল কিনেছি ছয় হাজার ৪২৪ টাকা দিয়ে। এরসঙ্গে আমাকে ছয় হাজার টাকার চাল কিনতে হয়ছে। এই হচ্ছে অবস্থা। তবে আমি অন্য মাল না কিনলে সয়াবিন তেল বিক্রি করব না, এটা করি না। যার যা লাগে সেটাই কিনতে পারেন।’
মিরপুরে জিসান জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা বলেন, ‘কোম্পানি থেকে সয়াবিন তেল দেয় না, তাই বিক্রিও করি না। মানুষ এসে ফিরে যায়। কী আর করার! আমার হাতে তো আর কিছু নাই।’
কোথাও কোথাও তেলের সঙ্গে কিনতে হচ্ছে অন্য পণ্য
সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি খুচরা দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি করছে। তেলের গায়ের রেটই বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো দোকানে ক্রেতাদের সবাইকে গড়ে তেল দিতে চাচ্ছেন না বিক্রেতারা। কারণ জানালেন—তেলের চরম সংকট। সেজন্য যারা ওই নির্দিষ্ট দোকান থেকে অন্যান্য পণ্য কিনছেন, তাদের তেল দেওয়া হচ্ছে।
রামগঞ্জ জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, আমার কাছে এখন তেল নেই। সকালে আট বোতল, অর্থাৎ ৪০ লিটার বিক্রি করছি। ১৭৬ টাকা লিটার ধরে পাঁচ লিটার ৮৮০ টাকা বিক্রি করছি। ধরেন, আমার প্রতিদিন দরকার ১০ কার্টন (প্রতি কার্টনে ২০ কেজি)। কিন্তু পাচ্ছি দুই কার্টন। তেলের সংকট আছে বাজারে। নামিদামি দুইটি কোম্পানির তেল পাওয়া যাচ্ছে। পরিচিত দুটি কোম্পানির তেল বাজারে নেই। আমরা তেল সবার কাছে বিক্রি করতে পারছি না। যারা অনেক বেশি বাজার করছে, তাদের হয়তো পাঁচ লিটার দিতে পারছি।
কুমিল্লা জেনারেল স্টোরের মালিক মুজিবর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আজ শুক্রবার বিকেলে তেল এসেছে। তেল চাহিদামতো পাচ্ছি না। তেল কম কম দিচ্ছে। শুনেছি, কোম্পানিগুলো তেলের দাম বাড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু সরকার বাড়াতে চাচ্ছে না। সেজন্য, তেলের চাহিদামতো সাপ্লাই দিচ্ছে না। মজুত করছে। যেন চাপে পড়ে সরকার দাম বাড়ায়।
বোতলের তেল যে কারণে বিক্রি হচ্ছে খুলে
সরকার নির্ধারিত দাম হিসেবে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮১৮ টাকা এবং প্রতি লিটার বোতলজাত পাম অয়েলের দাম ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা। খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৪৭ টাকায় বিক্রির কথা।
বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খোলা তেল লিটারের পরিবর্তে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা থেকে ১৯০ টাকায়। অথচ, সরকার নির্ধারিত দাম লিটারের পরিবর্তে কেজি প্রতি হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৬৭ টাকা। সেই তেল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১৮৪ টাকা থেকে ১৯০ টাকা পর্যন্ত। তাতে লাভের পরিমাণ দেখা যায় অনেক; কেজিতে ১৭ টাকা থেকে ২৩ টাকা। যদিও ততোটা লাভ হচ্ছে না বলে জানান বিক্রেতাদের অনেকে। তারা বলেন, খোলা তেল নাকি কিনতেই কেজিপ্রতি পড়ছে ১৮২ টাকা। এই হিসাব বলছে, ১৯০ টাকায় বিক্রি করলে কেজিপ্রতি খোলা তেলে লাভ হচ্ছে আট টাকা। অথচ, বোতলজাত তেল বিক্রি করলে লিটারপ্রতি লাভ হচ্ছে মাত্র দুই টাকা, দাবি বিক্রেতাদের।
আবার আরও একটি সমীকরণ আছে এর মধ্যে। জানা যায়, খুলে তেল বিক্রি করলে শুধু যে তেল থেকে লাভ বেশি পাচ্ছেন তা না, বোতল বিক্রি করেও মিলছে আয়। সব মিলিয়ে কেজিপ্রতি লাভ বেড়ে যাচ্ছে আরও তিন-চার টাকা।
মূসক কমানোর সিদ্ধান্ত
১৪ নভেম্বর বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন সচিবালয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বৈঠকে বাণিজ্যসচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান মইনুল খান, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সার্বিক দিক তুলে ধরে বিটিটিসি। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির দাবি জানান। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হার ১০ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এক মাস আগেই (গত ১৭ অক্টোবর) মূসক হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। গতকাল মূসক কমানোর সিদ্ধান্তের পরে উৎপাদকেরা বোতলজাত তেলের সরবরাহ বাড়াতে রাজি হন।