ফুটবল
দেশীয় ফুটবলের আইকন কোথায়?
সত্তর-আশি-নব্বই দশকে ঢাকার ফুটবল মানে উত্তেজনা, উন্মাদনায় ঠাসা নানা উপাখ্যান। দলবদলের আগে থেকে লিগ শেষ হওয়া পর্যন্ত কত ঘটনা-দুর্ঘটনা কত চমকপ্রদ কাহিনীর জন্ম দিত ঢাকার ফুটবল! সেসব কাহিনীর মাঝে খুঁজে পাওয়া যেত কত মানুষের ফুটবলীয় আনন্দ-বেদনা-উল্লাস-উচ্ছ্বাসের তীব্রতা। আর মাঠের ফুটবলাররা তখন রূপকথার নায়কের মতো। ক্লাবে তাঁদের দেখার জন্য হাজার হাজার কৌতূহলী চোখ! রাস্তায় বের হলে তাঁদের ঘিরে জনতার ভিড়! তখন অবশ্য সেলফি জমানা আসেনি। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের টোয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ কাভারেজের ইঁদুর-দৌড় শুরু হয়নি! ক্রিকেট নামক খেলাটার সঙ্গে এ দেশের মানুষের তেমন পরিচয়ও ঘটেনি। অভিজাত পরিবারের ছেলেদের আভিজাত্যের প্রতীক ক্রিকেট। সেই দিনগুলোর কথা উঠলে কেউ কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ভোগেন নস্টালজিয়ায়।কারো কাছে মনে হয় রূপকথা। কারো কাছে মিথ!
তবে আপনি যাই মনে করুন, ফুটবল ছিল বাঙালির জীবনের বড় বিনোদন। রুপালি পর্দার জনপ্রিয় তারকারাও টেলিভিশন, রেডিও, অথবা পত্রিকার পাতা পড়ে খোঁজ-খবর রাখতেন ঢাকার ফুটবলের। তাঁদের মাঝেও ছিল আবাহনী-মোহামেডানের একটা বিভাজন রেখা। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানে শুধু ঢাকা নয়, গোটা বাংলাদেশের আকাশের চেহারা পাল্টে যেত। সেটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত যখনই হোক। আকাশি-নীল-হলুদ, সাদা-কালো পতাকায় ছেয়ে যেত! ম্যারাডোনা-সক্রেটিস-জিকো-প্লাটিনি-রোসি-রুড খুলিত-রাইকার্ড-মালদিনি-ব্যাজিও-বারেসির মতো বড় বড় নাম টেলিভিশনের সৌজন্যে এ দেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর পরও সালাউদ্দিন-চুন্নু-সালাম-বাদল-আশীষ-ওয়াসিম-টুটুল-মঞ্জু-কায়সার হামিদ-মোনেম মুন্নাদের ভিউকার্ড বিকিয়েছে ভূরি ভূরি। শুধু ফুটবলারদের ভিউকার্ড বিক্রি করেও কত মানুষ সেই সময় লাখোপতি হয়ে গেছে!
গত দুই দশকে পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপটে মনে হতে পারে ক্রিকেট বাঙালির এক নম্বর খেলা। জাতীয় দলের কমবেশি সাফল্যে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনাটা বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে তার পুরোটাই জাতীয় দলকে ঘিরে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে ঘিরে। বাঙালির ধমনীতে এখনো ক্রিকেটকে ঘিরে রক্ত সঞ্চালনের চাপ ভারসাম্য বজায় রেখে হচ্ছে না। তাই এখনো ক্লাব ক্রিকেট বলুন, ঘরোয়া ক্রিকেট বলুন, গ্যালারি খা-খা করে! যেটা এখন ফুটবলের নিয়মিত দৃশ্য!
তবু ফুটবল বাঙালির প্রাণের খেলা। জনপ্রিয় খেলা। শুধু তার ফোকাসটা শিফট হয়ে গেছে। তা না হলে একজন মেসি কোপা আমেরিকায় পেনাল্টি শুটআউটে গোল করতে ব্যর্থ হলে এ দেশের মানুষের চোখের পাতা ভিজবে কেন! কেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেসির আবেগ তাড়িত অবসরের ঘোষণায় আবেগের জোয়ারে ভেসে স্ট্যাটাস দেবে বাঙালি! কেন রোনালদোর খেলা থাকলে সাত থেকে সতেরো, সাতাশ থেকে সাতচল্লিশ, সাতান্ন থেকে সাতাত্তর, সব বয়সী মানুষ রাত জেগে বসে থাকবেন টেলিভিশন সেটের সামনে! আসলে টেলিভিশনের সৌজন্যে ফুটবল গ্রহে এখন আর কোনো সীমারেখা খুঁজে পায় না বাঙালি। আর না পাওয়ার বড় একটা কারণ, তাঁর নিজের দেশ সেই গ্রহে এখনো তেমন দাগ ফেলতে পারেনি।
এ দেশের ফুটবলে আগে সবটাই ছিল প্রায় ক্লাবকে ঘিরে। সেই ক্লাব সংস্কৃতিতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। ক্লাবগুলোর গায়ে এঁটে দেওয়া হয়েছে ‘লিমিটেড’ সাইনবোর্ডে। সেখানে ধাক্কা খাচ্ছে ক্লাব ঘিরে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা! মুখ থুবড়ে পড়ছে ক্লাবকে ঘিরে তাঁদের আবেগ। তাই গ্যালারিতে দেখা যায় না আর কোনো ক্লাবের পতাকা! টিকেটের জন্য শোনা যায় না কোনো হাহাকার। ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার স্রোতে শুকিয়ে গেছে। ঢাকার লিগের খোলস পাল্টাতে গিয়ে বলা হচ্ছে পেশাদার লিগ। অথচ ক্লাবগুলো পেশাদারত্বের ‘প’-অক্ষরের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস এখনো সেই চাঁদা। অথচ তারা লিমিটেড কোম্পানি! অপেশাদারি আবকাঠামোর ওপর পেশাদার লিগ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নাকি! বাংলাদেশেও পারছে না।
বাংলাদেশ ফুটবলে হচ্ছে না। কিছু হচ্ছে না। আলোচক-সমালোচকদের মুখেও সেই একই কথা। কিছু হচ্ছে না। আর হচ্ছে না, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে বারবার টেনে আনা হচ্ছে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স। জাতীয় দলের কোচ বদল হচ্ছে কেন বারবার? এসব প্রশ্নই সামনে চলে আসছে। আসবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক লাগে যখন পুরোনো দিনের ফুটবলাররারও সেই সব কথা বলছেন। সমালোচনার জন্য সমালোচনা করছেন! ফুটবলের সেই রমরমা দিনগুলোতেও কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় দল খুব ভালো করেছে তার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। মারদেকা টুর্নামেন্টে পাঁচ গোল –ছ’গোল তারাও খেয়েছেন। সেটা ভুলে যাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলার সুযোগই তৈরি করতে পারেননি। প্রাক- বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলার সময়ই শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। আর বলার মতো সাফল্য নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় মোনেম মুন্না-অটো ফিস্টার জমানায় মিয়ানমার থেকে চার জাতি ট্রফি জয়।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক সাফল্য আর কী! সাউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের মাঠে শিরোপা, সাফ গেমসে কাঠমান্ডু থেকে গোল্ড মেডেল জেতা। এর বাইরে কী আছে? এখন জাতীয় দল সাফল্য পাচ্ছে না এটা সত্যি। কিন্তু ফুটবল তো গোলের খেলা। সেই গোলের কথাটা মাথায় রাখলে আগের বড় বড় তারকাও যে কিছু করতে পারেননি সেটা বলতেই হবে। তাতে কারো ‘আমিত্বে’ আঘাত লাগলে করার কিছু নেই। বলার কিছু নেই।
তবে এটাও ঠিক বাংলাদেশ ফুটবলের এই সময়টাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার সেটা করা হয়নি। হচ্ছে না। কারণ, অর্থ সংকট। যে দেশে প্রত্যেকটা অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ে কয়েক গুণ। শুধু বাড়ে না, ক্রীড়া বাজেটে বলার মতো অঙ্কটা! ফুটবল তো তার থেকে ছিটেফোঁটা কিছু পায়! কোটি কোটি টাকার গল্প হয়তো শোনা যায়। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে একজন ঊর্ধ্বতন সকরাকরি কর্মকর্তা ক’টাকা বেতন পেতেন, এখন কত পান? মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সবার বেতন ভাতা, সুযোগ- সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু ক্রীড়াবিদের সুযোগ-সুবিধা সেই তুলনায় কতটুকু বেড়েছে? আগে হয়তো ফুটবলাররা রিকশায় চড়ে ক্লাবের প্র্যাকটিসে আসতেন। একটা মোটরসাইকেল কিনতে পারলে তাঁরা খুশি হতেন। এখন ফুটবলাররা নামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে করে আসেন। ক্লাবে থাকেন না। নিজের দামি ফ্ল্যাটে থাকেন। এই আর্থিক পরিবর্তন তো সমাজের আরো অনেকের বেলায়ই ঘটেছে।
তবে হ্যাঁ, সালাউদ্দিন, সালাম, চুন্নু, বাদল রায়, টুটুলরা জাতীয় দলকে তেমন বড় কোনো সাফল্য এনে না দিতে পারলেও নিজেদের তারকা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এখনো তাঁদের অনেকে সেই স্টারডমটা ধরে রাখতে পেরেছেন খেলা ছাড়ার এত বছর পরও। সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্রিলিয়ান্সির কারণে। ওদের নিজস্ব কিছু ক্যাপটিভ অডিয়েন্স ছিল। যা এখনকার ফুটবলারদের নেই। তার আরো একটা কারণ, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিও এখন মুখটা সরিয়ে নিয়েছে দেশজ ফুটবল থেকে!
তাই এখনো বাংলাদেশ ফুটবলের আইকন বা বড় বিজ্ঞাপণ সত্তর-আশি-নব্বই দশকের প্রিয়মুখগুলোই।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি