হারিয়ে যাওয়া দেশ
গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয় অনেক স্বাধীন দেশ। সর্বশেষ ২০১১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে মানচিত্রে যোগ হয় ‘দক্ষিণ সুদান’। তবে সব সময়ই যে নতুন নতুন দেশ যোগ হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ইতিহাসের এই ভাঙাগড়ার খেলায় অনেক দেশ হারিয়েও গেছে। জিওগ্রাফি ডটকমের সৌজন্যে জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া দেশের কথা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২-১৯৯১)
১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই সোভিয়েত কর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল। বিশ্বের প্রথম এই সমাজতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে নিরন্তর অস্ত্র প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষের লড়াই, পরমাণু বোমার হুমকি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সংগ্রামের কাহিনী। প্রায় দুই কোটি ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটির অধিকারে ছিল বিশ্বের মোট ভূভাগের এক-ষষ্ঠমাংশ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেয় রাশিয়াসহ ১৫টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র।
চেকোস্লোভাকিয়া (১৯১৮-১৯৯২)
১৯১৮ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি থেকে বের হয়ে মধ্য ইউরোপে উদয় হয় নতুন এক রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়া। মূলত চেক ও স্লোভাক জাতিগোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে গঠিত এই রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তৎকালীন কমিউনিস্ট ব্লকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চেকোস্লোভাকিয়া উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছিল। পরে ১৯৯২ সালে এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের (ভেলভেট বিপ্লব) মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেয়।
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি (১৮৬৭-১৯১৮)
১৮৬৭ সালে অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবুর্গ রাজপরিবারের সঙ্গে হাঙ্গেরির রাজপরিবারের সম্মেলনে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির উদ্ভব হয়। মধ্য ইউরোপের এই রাষ্ট্রটির ইতিহাস পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ও নিজের অভ্যন্তরীণ অসংখ্য জাতির মধ্যে নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহে ভরপুর। ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী এই দেশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে লড়াই করে। যুদ্ধে পরাস্ত হলে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ভেঙে মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়াসহ অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
যুগোস্লাভিয়া (১৯১৮-২০০৬)
১৯১৮ সালে দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়া-হার্জেগোভিনা মিলে গঠন করে নতুন রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়া। যুগোস্লাভিয়া নামের অর্থ দক্ষিণ স্লাভদের দেশ। পূর্ব ইউরোপের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বৃহত্তর স্লাভ জাতির অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির কাছে পরাজিত যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের পরে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পরে নব্বইয়ের দশকে একে একে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া আর স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ নাম নিয়ে কিছুকাল টিকে থাকলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে গেলে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি।
দক্ষিণ ইয়েমেন (১৯৬৭-১৯৯০)
১৯৬৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিসর সমর্থিত দক্ষিণ ইয়েমেন স্বাধীনতা লাভ করে। এর রাজধানী ছিল আদেন। ইয়েমেনের উত্তর অংশের অঞ্চলগুলো নিয়ে এর আগেই উত্তর ইয়েমেন নামে একটি রাষ্ট্র ছিল। দুই ইয়েমেনের সীমান্তে হরদম গোলাগুলি লেগেই থাকত। পরে ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন পুনরায় একত্র হয়ে যায়। গেলে কী হবে, ইয়েমেনের শাসনব্যবস্থায় নানা গোত্রের অংশগ্রহণ নিয়ে রেষারেষি এখনো বিদ্যমান। সম্প্রতি দক্ষিণ ইয়েমেনকে পুনরায় স্বাধীন করার লক্ষ্যে অল্পবিস্তর সশস্ত্র সংগ্রাম দেখা যাচ্ছে।
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি (১৯৪৫-১৯৮৯)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি ও গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানি। দুই দেশের সীমান্ত ছিল সে সময়ের হিসাবে সবচেয়ে কড়াভাবে সুরক্ষিত। পূর্ব জার্মানি থেকে প্রায়ই লোকে পালিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেত। এই প্রবৃত্তি ঠেকানোর জন্য ১৯৬১ সালে নির্মিত হয় কুখ্যাত বার্লিন প্রাচীর। যা হোক, ১৯৮৯ সালে পতন ঘটে এই প্রাচীরের, দুই জার্মানি এক হয়ে যায়।
সিকিম (১৬৪২-১৯৭৫)
১৬৪২ সাল থেকে স্বাধীন সিকিম রাজ্যটি ১৮৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করদরাজ্যে পরিণত হয়। এর পরে ১৯৫০ সাল থেকে ভারতের অধীনে নামমাত্র স্বাধীনতা নিয়ে টিকে ছিল দেশটি। শেষমেশ ১৯৭৫ সালে সিকিমের রাজতন্ত্রের বিলুপ্ত ঘটে। সিকিম ভারতের সঙ্গে যোগ দেয় পাকাপাকিভাবে।
গ্রান কলম্বিয়া (১৮১৯-১৮৩০)
বর্তমান কলম্বিয়া, পানামা, ভেনেজুয়েলা আর ইকুয়েডরের সমন্বয়ে গঠিত এই প্রজাতন্ত্র বলতে গেলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৮৩০ সালে ভেনেজুয়েলা আর ইকুয়েডর স্বাধীন হয়। পানামা আরো প্রায় সাত দশক পরে স্বাধীনতা লাভ করে।