কলেজছাত্রী হত্যায় কথিত প্রেমিকের দায় স্বীকার
একাধিক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলায় কলেজছাত্রী তন্বী রায়কে গলা টিপে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালত জবানবন্দি দিয়েছেন তাঁর কথিত প্রেমিক রানু রায়।
জবানবন্দিতে তন্বীকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দেন রানু। গতকাল শনিবার রাতে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান।
পুলিশ সুপার জানান, ঘাতক রানু রায় নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছেন। ধরা দেওয়ার পর হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নিশাত সুলতানার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন নবীগঞ্জ শহরের জয়নগর এলাকার রানু।
স্বীকারোক্তিতে রানু জানান, নবীগঞ্জ পৌর এলাকার শিবপাশা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় তন্বী রায়ের বাবা বিমল রায় ও তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছিলেন। এ সুবাদে বিমল রায়ের মেয়ে তন্বী রায়ের সঙ্গে রানুর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঘটনাটি পরিবারের লোকজনদের মধ্যে জানাজানি হলে রানুর বাবা কানু রায় তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্যত্র চলে যান। সেখানে যাওয়ার পরও নিয়মিত তন্বীর সঙ্গে রানু রায়ের মোবাইল ফোনে কথা হতো এবং প্রায় সময়ই দুজনের দেখা হতো।
জবানবন্দিতে আরো উল্লেখ করা হয়, রানুকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন তন্বী। এসব প্রেমিকের কাছ থেকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রীও নিতেন তিনি। সবশেষ তন্বীর বাসার ভাড়াটিয়া জনৈক শিক্ষকের সঙ্গে তন্বীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্কের কথা জেনে যান রানু রায়। এতে তন্বীর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রানু। এ নিয়ে তন্বীর সঙ্গে রানু রায়ের মোবাইল ফোনে ঝগড়া হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টার দিকে রানু রায়ের অসুস্থতার খবর শুনে তন্বী তাঁর বাসায় দেখা করতে যান। এ সময় রানুর মা, বাবা ও বোন বাসায় ছিলেন না। একপর্যায়ে রানু রায় তন্বীকে অন্যদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে সন্দেহ করে কথাবার্তা বললে তন্বী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং রানুর গালে চড় মারেন। এতে রানু রায় উত্তেজিত হয়ে তন্বীর গলা টিপে ধরেন। কিছুক্ষণ গলা টিপে ধরে রাখার পর তন্বীর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় রানু বুঝতে পারেন তন্বী মারা গেছেন।
স্বীকারোক্তিতে রানু রায় জানান, তিনি তন্বীর লাশ গোপন করার পরিকল্পনা করেন। একপর্যায়ে বাসার ব্যবহৃত বস্তার মধ্যে তন্বীর লাশ ঢুকিয়ে বাসার ভেতরে লুকিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁর মা, বাবা ও বোন বাসায় ফেরেন । রাতে পরিবারের লোকজন ঘুমিয়ে পড়লে সুযোগ বুঝে রানু নিজের বাসার সামনে ইট থাকা সত্ত্বেও পাশের বাসায় থাকা বাহুবলের শামীম ব্রিক ফিল্ডের ইট এনে বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে লাশ পাশের নদীতে ফেলে দেন।
গত ২০ সেপ্টেম্বর নবীগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়কের নবীগঞ্জ পৌরসভার পাশে বরাক নদীর গড়মুড়িয়া সেতুর নিচে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ অর্ধগলিত এবং হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। খোঁজাখুঁজির পর লাশের পরিচয় পাওয়া যায়। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে তন্বীর বাবা বিমল রায় নবীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরবর্তী সময়ে তন্বী হত্যার ঘটনায় রানু রায়কে সন্দেহ করে পুলিশ তাঁর বাসায় গিয়ে পরিবারের কাউকে পায়নি। একপর্যায়ে পুলিশ ঘরের তালা ভেঙে হত্যায় ব্যবহৃত নানা আলামত উদ্ধার করেন।
এ পরিস্থিতিতে রানু ও তার পরিবারের লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে রানু রায়। তার অপরাধের কারণে তার পরিবারের লোকজনকেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ জন্য তিনি পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জবানবন্দিতে জানান।
পুলিশের হাতে রানু রায়ের ধরা দেওয়ার ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড বিষয়ে গত রাতে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার আগের দিন তন্বীর সঙ্গে রানু রায় প্রায় ৪০ বার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। বেশির ভাগ কলই তন্বী তাঁর মোবাইল ফোন থেকে করেছেন। তাঁদের মোবাইল ফোন খতিয়ে দেখে আরো অনেক তথ্য বের হয়ে আসছে।
ধর্ষণের পর তন্বীকে হত্যা করা হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের বিষয়টি রানু স্বীকার করেননি। তবে তাঁদের মাঝেমধ্যে দৈহিক সম্পর্ক হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন রানু।
হত্যাকাণ্ডে আর কেউ জড়িত আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, স্বীকারোক্তিতে তন্বীকে তিনি হত্যা করতে চাননি বলে জানিয়েছেন। কিন্তু রাগে তাঁর গলা চেপে ধরেছিলেন। এতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
একটি মেয়েকে রানু একা কীভাবে খুন করে ভারী লাশ নদীতে নিয়ে ফেলল তা জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, তাঁকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে অন্য কারো জড়িত থাকার কথা সে স্বীকার করেনি। তিনি বার বার বলেছেন, মেয়েটি হালকা গড়নের ছিল। যে কারণে বস্তায় ভরে টেনে নদীতে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন- এ ব্যাপারে রানুর মোবাইল ফোনের কললিস্ট তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তন্বী হত্যার পর তাঁর মা, বাবা ও পরিবারের লোকজনদের মধ্যে তাঁর জন্য কোনো সুহানুভূতি দেখা যায়নি। এতে মনে হয়েছে, পরিবারের লোকজন মেয়েটির আচরণে বিক্ষুব্ধ ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আ স ম সামছুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সুদীপ্ত রায়, এএসপি সাজিদুর রহমান, গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজমেরুজ্জামান, উপপরিদর্শক (এসআই) সুদীপ রায়, এসআই আব্দুল করিম প্রমুখ।