উপন্যাস পর্ব ২
বাবা আছে বাবা নেই
রাত দ্বিপ্রহর পেরিয়ে গেছে। মাকে জড়িয়ে শুয়ে আছি। এরই মধ্যে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শেয়ালের পাল বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। হুক্কা হুয়া ডাকতে থাকে। সুযোগ বুঝে হাঁস-মুরগি নিয়ে যায়। এখনো তাই হচ্ছে। আশপাশে শেয়ালের দাপাদাপি শুনতে পাচ্ছি। রাত-বিরেতে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে উঠলেও শেয়ালের মুখোমুখি হতে হয়। পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করে।
মোরগের পাখা ঝাপটানি আর ক্যাক ক্যাক চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। তাহলে শেয়াল কি মোরগ ধরল? তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যের সময় আমি তো নিজ হাতে হাঁস-মুরগির ঘরে কপাট লাগিয়েছি। তাহলে কি চাচাদের মোরগ?
যাক গে। এখন আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষরূপী শেয়ালদের কথা ভাবছি। যারা নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ খুন করেছে। আর নারীদের নির্যাতন করেছে। শেয়ালেরও ধর্ম আছে। একটা খাবার পাওয়ার পর অতিরিক্ত খাবারের জন্য ছোটে না। কিন্তু মানুষরূপী শেয়ালগুলোর কোনো ধর্ম ছিল না। তারা ঘরে ঘরে নির্যাতন চালিয়েছে। মানুষ খুন করেছে। জায়গা দখল করেছে।
আমি একজন রাজাকারের মেয়ে। আমার বাবা খুনি। নারী নির্যাতনকারী। একথা ভাবতেও আমার অবাক লাগছে। কিন্তু বাস্তবে তা-ই সত্যি। মৌলানা শরাফত খান। আমার জন্মদাতা হওয়া সত্তেও তাকে আমি বাবা ডাকতে ঘৃণা করি। তিনি দারুল মারূফ মাদ্রাসার হেড মৌলানা। পাড়ার মসজিদের ইমাম। এলাকার সালিস-বিচারে যার মুখ্য ভূমিকা থাকে। লম্বা দাঁড়ি। গোলগাল টুপি মাথায়। হাতে তসবিহ। মুখে ধর্মের পাপ-পুণ্যের বয়ান।
নারীর পর্দা। আর আখিরাতের হুঁশিয়ারি। যিনি শত শত ছেলেমেয়েকে হাদিস-কোরানের জ্ঞান দেন। মাঝেমধ্যে ফতোয়া দিতেও ছাড়েন না। তিনি একজন নরঘাতক। ধর্ষক। লুটেরা।
কথাটা কার কাছে শুনেছি তা আর আজ মনে নেই। তবে কথাটা হলো এই। মানুষ জন্মের সময় চেহারায় নূর অর্থাৎ ঐশ্বরিক আলো নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে চেহারায় মায়া থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ যত বেশি পাপ করে, চেহারা তত পবিত্রতাশূন্য হয়ে পড়ে। মায়া কমে যায়। এবং একপর্যায়ে বীভৎস মনে হয়। মৌলানা শরাফত খান দাড়ি টুপি আর আলখেল্লায় পীর-দরবেশ মনে হলেও চেহারায় পবিত্রতা নেই। সে যে একজন নরঘাতক, ধর্ষক তা চেহারাতেই যেন ফুটে উঠছে।
হঠাৎ আমার জন্মদাতার চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল। ঘৃণায় এক দলা থুতু মুখে এসে পড়ল। যে লোকটাকে গতকালও আমি বাবা বলে ডেকেছি, আজ তার চেহারা মনে পড়লেই ঘৃণা হচ্ছে।
ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতিও। আমি অপজন্মা। আমার শরীরে অপরক্ত। আর আমার জন্মদাতা অপশক্তি। মায়ের জন্য আমার খুব করুণা হচ্ছে। সে কেন জেনেশুনে এমন নরপিশাচকে বিয়ে করল। নাকি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল, সে রহস্য আমাকে জানতেই হবে।
বেশ কদিন ধরে আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। আমি নিজে থেকেই যাচ্ছি না। মৌলানা শরাফত খান কয়েকবার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছেন। কারণ কী? মা বলেছেন, আমি অসুস্থ।
তিনি বললেন, বিজয় ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসতে। পেছনে আমি হাসলাম।
রমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। রমাও নিশ্চয় ওর মায়ের কাছে শুনেছে। কেন সেদিন ওর বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। কেন সেদিন বিজয় ডাক্তারের অগ্নিমূর্তি সবাইকে দেখতে হয়েছিল। আমি রমাকে এ মুখ দেখাব কী করে। মাথা যে ধুলোয় মিশে গেল। তারপরও একদিন আমি রমার মুখোমুখি হব। ক্ষমা চাইব।
মৌলানা শরাফত খানকে আমি বাবা বলে না ডাকলেও তিনি আমাকে মা বলে ডাকেন। এড়িয়ে চলি। নিরূপায় হয়ে উত্তর দিই। তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু মুখ খোলেন না।
প্রতি রাতে মায়ের সাথে ঘুমাই। শিমু ঘুমিয়ে পড়লে আমরা কথা শুরু করি। মাঝে মাঝে আমার জন্মদাতা হাঁক ছাড়েন। কী রে তোরা এত কী কথা বলিস?
মা আর আমি চুপ করে যাই। খানিক পর আবার শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনি।
নিবু নিবু হারিকেনটা নিভিয়ে দিল মা। বাম ডান করে গালে পান চিবুচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে। পাশে শিমু চ্যাংদোলা হয়ে ঘুমোচ্ছে। টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। এবার মনে হয় বন্যা হয়ে যাবে। বাড়ির পেছনে পুকুর পাড় থেকে বিস্তীর্ণ ধানিজমি। তারপর নদী-চর। নদীতে জোয়ার এলে এমনিতেই জমি ডুবে যায়। এখন তো অবিরাম বৃষ্টি।
হালকা কাঁথা জড়িয়ে মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে আছি। মায়ের পান চিবানো শেষ। পাশে রাখা জগ থেকে ঢক ঢক করে জল খেল।
আচ্ছা মা তুমি কি জেনেশুনে এই নরপিশাচটাকে বিয়ে করেছিলে?
হু।
আমি বড় হয়েছি। তুমি সব কথা আমাকে খুলে বলতে পারো। আমাকে যে সবকিছু জানতে হবে মা।
তোর বাবা যদি...।
থামো মা।
মায়ের কথা শেষ না হতেই থামিয়ে দিলাম। মা ওই নরপিশাচটাকে আমার বাবা বলবে না। আমি তাকে বাবা ডাকতে ঘৃণা করি। তুমিও নিশ্চয় তাকে স্বামী বলতে ঘৃণা করো।
সমাজে টিকে থাকার জন্যই...।
বাদ দাও তো মা সমাজ। যে সমাজ জেনেশুনে নরপিশাচকে, রাজাকারকে সমাজপতির চেয়ারে বসায় সে সমাজ আমি মানি না। আমি সে সমাজে থাকতে চাই না।
চুপ কর রাবু। অত জোরে বলিস না। শুনবে যে।
আচ্ছা বলো।
এ ঘরের লোকটা, মৌলানা সিরাজুল ইসলাম ও আরো অনেকে পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদেরই ওরা শেষ করত। রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে মেয়েদের নির্যাতন করত। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। তোদের স্কুলের পেছনে কলঘরে বন্দি রেখে পালাক্রমে নির্যাতন করত।
কী বলছো মা?
হ্যাঁ।
তখন রেলওয়ের মেকানিক ছিল আহম্মদ মকবুল খান। সে খুব বদ লোক ছিল। মুক্তিবাহিনীর লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের পরিবারের বউ-ঝিদের ধরে নিয়ে যেত। আর আহম্মদ মকবুল খান তাদের একে একে জবাই করত। শুনেছি জবাই করার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে লবণ আর গুঁড়ো মরিচ মাখত। তারপর ছুরি চালাত। হাতে-পায়ে শরীরে ছুরির পোছ দিয়ে মাংস ফাঁক করে সেখানে লবণ-মরিচ দিত। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মুক্তিযোদ্ধারা মারা যেত।
সে সময় এ গ্রামে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মেজর নাসের। তার সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ ছিল। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা গ্রামের যুবতী মেয়েদের ধরে ধরে মেজর নাসেরের খোয়াড়ে দিয়ে আসত। অনেকের লাশ পাওয়া যেত। আর অনেকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরিয়ে আসত। যারা বেরিয়ে আসত তাদের মনে হতো পাগলা গারদ থেকে বেরিয়ে আসছে। জামা-কাপড়, শাড়ি ছেঁড়া। বিচ্ছিন্ন। টলতে টলতে পড়ে যেত। আবার হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়াত।
মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে আমি আঁতকে উঠি। মুষলধারে বৃষ্টি থেমেছে। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছি।
মা, তারপর?
মৌলানা আজরাইল সোবহান নামে এক ভয়ানক লোক ছিল। পাকিস্তানি মেজর নাসের তাকে বলত বহুত খতরনাক আদমি। মানুষ জবেহ করা তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। হিন্দুদের জবেহ করার জন্য এক ধরনের ছোরা, মুসলিমদের জন্য এক ধরনের আর মেয়েদের জন্য অন্যরকম ছোরা ব্যবহার করত। জবেহ করার আগে লুঙ্গি খুলে দেখে নিত সে হিন্দু কি মুসলিম।
আজরাইল সোবহান বলত, ‘গুলি চালিয়ে রুপাইয়া খরচ করে কাজ কি। ছুরির এক পোছেই কিচ্ছা খতম।’ মুরগি জবাইয়ের মতো মানুষ জবাই করতে পারত বলে তার নাম হয়েছিল আজরাইল সোবহান। আজরাইল সোবহানের নাম শুনেই সবাই ভয় পেত।
মা।
হুঁ।
আজরাইল সোবহান কি এখনো বেঁচে আছে?
না মা বেঁচে নেই। রেলওয়ের মেকানিক আহম্মদ মকবুল খান যে রাজাকার হয়ে বাঙালি মেরেছিল, তাকে শেষ করে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু আজরাইল সোবহানকে মারতে পারেনি। ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে পালিয়েছিল। কিন্তু সে ধরা পড়ে। ত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত সে প্রাইমারি স্কুলের ছাদের ওপর বসেছিল। বাঙালিরা আজরাইল সোবহানকে থুতু ছিটিয়েছে। খাবার ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে কিছুই খায়নি। না খেয়েই সে মারা গিয়েছিল। বাংলার মাটিতে তার কবর হয়নি। শিয়াল কুকুর, কাক-শকুনে খেয়েছে।
রাবু। মা ডাকল।
হু। মা।
এবার ঘুমা। রাত অনেক হয়েছে।
মা তুমি তো আমার আসল প্রশ্নেরই উত্তর দাওনি।
আসল প্রশ্ন আবার কোনটি?
ওমা। এরি মধ্যে ভুলে গেছ। শোন। মৌলানা শরাফত খান যে আমার জন্মদাতা তাকে কি তুমি পছন্দ করেই বিয়ে করেছিলে?
রাবু ঘুমিয়ে পড়ো।
না মা। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
মা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। গভীর নীরবতায় বৃষ্টির শব্দ প্রখর হয়ে আসে। মৌলানা শরাফত খানের গোঙানির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে তিনি ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন। কী সব আবোল তাবোল বকেন। উর্দুতে কথা বলেন। ‘খতম করদো। খতম করদো।’
এসব শুনে মনে করতাম মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের তিনি উর্দু শেখাচ্ছেন। রাতেও ঘুমের মধ্যে আওড়াচ্ছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মৌলানা শরাফত খানের ‘খতম করদো’-এর আসল মানে কি। কাকে খতম করতে বলছেন।
মা চুপ করে আছো কেন?
আমার আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।
ইচ্ছে করেই তুমি বলতে চাইছো না। বলো মা। বলো।
আচ্ছা শোন। তোর দুই মামাই তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
হ্যাঁ মা তা তো জানি।
তাদের ধরার জন্যই রাজাকারদের লোকজন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সে এক কালো রাত। তোর নানা অসুস্থ। বিছানায় শুয়ে কোমরের ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। ছখিনা মায়ের সাথে শুয়েছিল। ও তখনো ছোট। আর আমি পাশের ঘরে। তোর মামারা ঘরে ছিল না।
মাঝরাতে হঠাৎ শুনলাম কারা দরজা ধাক্কাচ্ছে। দপাদপ লাথি দিচ্ছে। বুঝতে পারলাম এবার আর রক্ষে নেই। বাবা কাতরাতে কাতরাতে বলল কে। মশিউর। শফিউর। বাইর থেকে কোন জবাব এলো না। দরজায় সমানে লাথি পড়ছে। বাবা কী যেন বলছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মা চিৎকার দিয়ে আমাকে ডাকল। মার ঘরে লুকানোর কোনো জায়গা নেই। নিজেকে কোথায় লুকোব বুঝে ওঠার আগেই ধপাস করে দরজা খুলে গিয়েছিল। তড়িঘড়ি চকির নিচে ঢুকে পড়লাম। আলুর বস্তার আড়ালে লুকোলাম বাড়ন্ত দেহটাকে।
ওরা বাবার সাথে তেমন মন্দ ব্যবহার করল না। খুঁজল আমার দুই ভাই মশিউর আর শফিউরকে। মায়ের ঘরে ঢুকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করল। ছখিনাকে টানাটানিও করেছিল। তার খানিক পরেই এক ধাক্কায় আমার ঘরের ছিটকিনি ছুড়ে পড়ল। চকির নিচে টর্চের আলো আমার চোখ ঝলসে দিল।
একটি কালো লম্বা হাত আমাকে চুল ধরে টেনে বার করল। তারপর...।
পুনরায় বলা শুরু করল মা।
আমার চিৎকারে আকাশ-বাতাস আন্দোলিত হলো। আড়ালের ঘুমন্ত হাঁস-মুরগিগুলো কলকলিয়ে উঠল। বাড়ির কার্নিশে শুয়ে থাকা কুকুরটি সেই কখন থেকে ঘেউ ঘেউ করছে।
বাবা সমানে চিৎকার করছে। মা ছখিনাকে সামলাতেই ব্যস্ত। আর এদিকে আমার যা হওয়ার তাই হয়ে গেলে। মা-বাবা কেউ কিছু করতে পারল না।
রাবু।
হু। মা। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল আমার বুক থেকে।
আর সে লোকটা কে ছিল জানিস? বলল মা।
কে?
তোর জন্মদাতা মৌলানা শরাফত খান। যে এখন পাঁচবেলা নামাজ মসজিদে পড়েন। রাত বিরেতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। মাদ্রাসায় হাদিস-কোরআনের বুলি ছাড়েন।
মা।
এ ঘটনার পর আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। একাত্তরে অনেক মেয়েই এই একই কারণে আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু তোর নানা-নানির কারণে পারিনি। মৌলানা শরাফত খানকে হাতে পায়ে ধরে রাজি করিয়েছিল আমাকে বিয়ে করতে। তোর মামারা মোটেও রাজি ছিল না।
বাবা আর মা আমাকে মৌলানা শরাফত খানের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে চেয়েছিল। আমার একটা গতি করে তারা হাফ ছেড়ে বাঁচল। আমিও নিরুপায় হয়ে বাবা-মায়ের মুখ রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কোনোদিন এ অসভ্য, বর্বর, হারামজাদাটাকে মেনে নিতে পারিনি। মৃত্যু পর্যন্ত পারবও না।
মা আমার জন্ম তো বাহাত্তরে?
হ্যাঁ। তুই একাত্তরের ফসল। যার বৈধতা দেওয়ার জন্যই আমাকে ওই হারামজাদাটার গলায় ঝুলতে হয়েছিল।
মেনে নিতে হয়েছিল নিষ্ঠুর পাষণ্ডকে।
পাতলা কাঁথাটা মা কখন গা থেকে ফেলে দিয়েছে টেরও পাইনি। ঘেমে ভিজে গেল। উঠে বসল। অস্ফুট স্বরে বলল, জল দে।
বিছানার কাছে রাখা জগটা হাতে তুলে দিলাম। মা ঢক ঢক করে জল খেল। ওড়না দিয়ে মায়ের মুখ মুছে দিলাম।
মনে হয় রাত শেষ হয়ে আসছে। কুক-কুরু কু…। মোরগের ডাক শুনতে পাচ্ছি। পুকুরপাড়ে গাছের সারিতে পাক-পাখালির পাখা ঝাপটানি। ক্যাচত ক্যাচত নলকূপ চাপার শব্দ। মৌলানা শরাফত খান তাহাজ্জুদের নামাজের অজু করছেন।
মাকে শুয়ে দিতে গিয়ে টের পেলাম মায়ের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। কাঁথাটা পুনরায় গায়ে জড়িয়ে দিলাম।
মা কাঁপছে। আমি মাকে বুকে জড়িয়ে আছি। ভোর পেরুলেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
(চলবে)