ক্রিকেট
বিপিএলের পথ ধরে সফল দেশি ক্রিকেট
২০১২ সাল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রাম কিংসের হয়ে ১৭ বছরের একটি ছেলে কোনো বড় মঞ্চে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে। প্রথম ওভারের প্রথম দুয়েকটা বল করেই চ্যানেল নাইনের ইংরেজি ধারাভাষ্যকারদের অকৃপণ প্রশংসা পেতে শুরু করে বোলারটি। ঢাকা ডায়নামাইটসের মারকুটে ব্যাটসম্যান ‘স্টিভেন্স’-এর স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে বিপিএলে নিজের অভিষেক উইকেট শিকার করেছিল সেই বোলারটি। সেই ১৭ বছর বয়সী বোলারটি আর কেউ নয়, বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেস আক্রমণের অন্যতম ভরসা ‘তাসকিন আহমেদ’। যিনি কিনা এই বিপিএল দিয়েই নিজেকে পরিচয় করান এবং দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচে অভিষিক্ত হয়ে ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ কাঁপিয়ে দিয়ে ৮ ওভার বল করে ৫ উইকেট নিয়ে বিশ্বক্রিকেটে নিজের আগমনের জানান দিয়েছিলেন। শুধু তাসকিন নয়, অনেক সেরা সেরা উদীয়মান কিছু খেলোয়াড় উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পেশাদার ক্রিকেট লিগ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএল যাত্রা শুরু করে। অনেকটা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আইপিএল-এর আদলেই বাংলাদেশেও এই পেশাদারি ক্রিকেট লিগ আয়োজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দেশীয় মোট ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই লিগ, দল গঠনের জন্য খেলোয়াড় নিলামের ব্যবস্থা চালু করে, যে নিলামে প্রতিটি দল দেশীয় ক্রিকেটারদের পাশাপাশি উন্নত মানের বিদেশি ক্রিকেটারদের সমাগম ঘটাতে থাকে। শুধু খেলোয়াড়ই নয়, অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের কোচিং স্টাফে ব্যাপক বিদেশি কোচ, ট্রেইনারদেরকে নিজেদের দলের সঙ্গে যুক্ত করে। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো শুরু হওয়া এই ক্রিকেট লিগ ২০১৬-১৭-তে এসে চতুর্থ মৌসুমে পা দেয় সাতটি ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে।
২০১২ সালে প্রথম আসর এবং ২০১৩-তে দ্বিতীয় আসর কিন্তু এরপরেই টি-২০’র এই জনপ্রিয় আসরটি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও সব সময়ই আয়োজকরা আগের দুটি আসরকে ‘সফল’ বলে এসেছেন; কিন্তু ক্রিকেটারদের পাওনা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অনিয়ম, সবশেষে দুর্নীতি আর অনিয়ম এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিপিএলে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দক্ষ দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সমস্যাটিকে আর পরবর্তী আলোচনায় আসতে দেওয়া হয়নি।
বিপিএলে প্রথমবার যে বিষয়টি লক্ষ করা গিয়েছিল তা হলো দেশি ক্রিকেটারদের অনুজ্জ্বল সাফল্য, ভালো গতি ও বৈচিত্র্যময় পেস বোলার, দক্ষ ও মারকুটে ব্যাটসম্যান, বৈচিত্র্যময় স্পিন বোলার ইত্যাদি বিষয়গুলোর যথেষ্ট অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায় কিন্তু বিপিএলের পরবর্তী আসরগুলোতে সেই ধারা যেন ক্রমেই পাল্টে যেতে থাকে এবং ম্যাচ বদলে দেওয়ার ভূমিকায় দেশীয় ক্রিকেটাররাই ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
বিপিএলের প্রথম সিজন থেকেই সবগুলো দল ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড় আর কোচিং স্টাফ নিয়োগ দিতে থাকে। যার ফলে এসব খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেশীয় খেলোয়াড়রাও অনেক উপকৃত হতে থাকেন। একই দলে যখন ব্যাপক বিদেশি খেলোয়াড়রা তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেন, নিজের ক্রিকেটীয় ধারণা ছড়িয়ে দেন তখন যেন বিপিএলের মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকে দেশের পুরো ক্রিকেটই।
বিপিএল প্রথম সিজন থেকে চতুর্থ সিজন। এই চার সিজনে বিপিএল অনেক তারকা ক্রিকেটার ও কোচদের সম্মেলন ঘটিয়েছে। ক্রিস গেইল, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, শহীদ আফ্রিদি, মারলন স্যামুয়েলস, সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেল, ব্রাভোদের পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ শেন জার্গেনসেন, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কোচ মিকি আর্থার, গ্রাহাম ফোর্ড, রবিন সিং, ডেভ হোয়াটমোর, স্টুয়ার্ট ল’দের মতো হাই প্রোফাইল কোচরা বাংলাদেশে কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন বিপিএলের কল্যাণেই। শুধু তাই নয়, বিপিএল কোচিং প্রতিভা বিকাশের জায়গা করে দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অনেক সাবেক খেলোয়াড়দেরও। এবার যেমন দেশীয় কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দীন, মিজানুর রহমান বাবুল, কোচ সারোয়ার ইমরানদের পাশাপাশি ঢাকা ডায়নামাইটস-এর প্রধান কোচ হলেন খালেদ মাহমুদ সুজন, রংপুর রাইডার্সের কোচ হলেন জাভেদ ওমর বেলিম, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নের পথকেই নির্দেশ করে।
যাত্রার শুরু থেকেই বিপিএল দেশীয় চ্যানেলের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় স্টার ক্রিকেট, জিও সুপার, ইএসপিএন স্টার স্পোর্টস-এর মতো চ্যানেলগুলোর কল্যাণে, যেটিও বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্ব মঞ্চায়ন বলে বিবেচিত হয়।
বিপিএলের প্রথম সিজনগুলোতে অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি ২০ কোটি টাকার ওপরেও খরচ করেছেন এ ভাষ্য স্বয়ং বিপিএল কর্তৃপক্ষেরই, তাই তারা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর ব্যয় কমিয়ে আনার কথা বলেছিলেন কিন্তু এর মাধ্যমেও উপকৃত হচ্ছেন দেশের অনেক ক্রিকেটার। জাতীয় দলের বাইরে থাকা, জাতীয় দলের আশায় বসে থাকা, অনেক উদীয়মান ক্রিকেটার, অনেক পুরোনো ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাবেক খেলোয়াড়রা বিপিএলের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে হলেও নিজের অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছেন। একদিকে যেমন প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে অনেক মানসম্মত বিদেশি খেলোয়াড় ও কোচদের সংযুক্ত করা যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ারের মাধ্যমে দেশীয় ক্রিকেটাররা নিজেদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার মজবুত করতে পারছেন, তেমনি বিপিএলের মাধ্যমে দেশের ক্রিকেটের মানোন্নয়নের কাজটিও যেন ফলপ্রসূ হচ্ছে। দেশীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, নিজেকে প্রমাণের একটি বিশ্বমঞ্চ পেয়েছেন ক্রিকেটাররা যেখানে ভালো করলে জাতীয় দলের দরজাও স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে। যেমনটি পেয়েছেন এনামুল হক বিজয়, সাব্বির রহমান, তাসকিন আহমেদের মতো দেশীয় তারকারা।
বিপিএলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কেমন হওয়া উচিত এ প্রশ্নে বলা যেতে পারে, এটাকে শুধু খেলা বা ব্যবসা মনে না করে যেন একটি খেলোয়াড় তৈরির কারখানা বলে মনে করা হয়। প্রতিটি ফ্রাঞ্চাইজিই বিদেশি কোচদের সঙ্গে দেশীয় কোচদের সহকারী হিসেবে রেখেছেন, অনেক দলে দেশীয় ক্রিকেটাররাই প্রধান কোচ হয়ে অনেক বিদেশি খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। দেশীয় এসব কোচ তাঁদের এই অভিজ্ঞতাকে কীভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, এগুলোকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়ন করা যায়, ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায় মোট কথা দেশের ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়ার পথে কাজে লাগানো যায়, বিপিএলের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে সেদিকেই দৃষ্টি রাখতে হবে।
দ্বিতীয় আসরে টাইটেল স্পন্সর হয় প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ২০১৪ সালে আট কোটি টাকার বিনিময়ে টাইটেল স্পন্সর কিনে নেয় বিআরবি গ্রুপ। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিরই অনেকগুলো নামিদামি স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠানগুলো বিপিএলের পাশাপাশি দেশের ক্রিকেটার তৈরির কারখানা অর্থাৎ ক্রিকেট একাডেমিগুলোতেও একটু বিনিয়োগের হাত বাড়িয়ে দেবেন- এটাই প্রত্যাশা যে একাডেমিগুলো কি না অর্থের অভাবে নিজেদের স্বাভাবিক কাজগুলো চালিয়ে যেতেই হিমশিম খাচ্ছে। বিপিএল যদি ক্রিকেটের উন্নয়ন করে থাকে তাহলে সেখানে ওই সব ক্রিকেট একাডেমির অবদানও অনস্বীকার্য।
অর্থের ছড়াছড়ি, আর টি-২০-এর উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দিয়ে আমরা যেন ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থানটুকু উন্নতির কথা ভুলে না যাই। বিপিএলের মাধ্যমে ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে কিন্তু ক্রিকেটের এই ফরম্যাট ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নয়নে খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারে না এটি অপ্রিয় হলেও সত্য, যার প্রমাণ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে। দেশীয় ক্রিকেটাররাও যেন টাকার জোয়ারে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজেদের প্রকৃত উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রাখবেন- সেটিই কাম্য আর বিপিএল তখনই কেবল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন উপকার বয়ে নিয়ে আসবে দেশীয় ক্রিকেটের এই অগ্রযাত্রায়।
বিপিএলের মাধ্যমে দেশের ক্রিকেটে যে একধরনের উৎসবমুখরতা শুরু হয় এবং শুরু হয়েছে, সেই উৎসবমুখরতা দীর্ঘায়িত হোক। সফলতার পথে এগিয়ে যাক বিপিএল, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ ক্রিকেট।
লেখক : সাবেক সভাপতি, স্পোর্টস সাস্ট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।