ধর্ষণের শিকার ছাত্রীকে ছাড়পত্র, চাপে পড়ে পরীক্ষার সুযোগ
ধর্ষণের শিকার সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ঘটনার পর পাঁচ মাস ধরে ক্লাস করার অনুমতি দেননি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি চাইতে গেলে কিশোরীর বাবাকে প্রধান শিক্ষক জানান, শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ।
এরপর একে একে পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ষষ্ঠ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ওই শিক্ষার্থী।
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম আজ রোববার সকালে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের চিচিরকোট গ্রামের এক শিক্ষার্থী পাশের নতুনবাজার শাহজালাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। পূর্বপরিচয়ে ওই শিক্ষার্থীদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন পাশের হিমারগাঁও গ্রামের সিদ্দিক আলীর স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৩)। তিনি ওই শিক্ষার্থীকে ঢাকায় নিয়ে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখান। গত ১৯ জুলাই ভোরবেলা ওই শিক্ষার্থীকে তার বাবা যশপাল গ্রামের মৃত হোসেন আলীর ছেলে জাহির হোসেন (৩৫) ও একই গ্রামের আজগর আলীর ছেলে সামছুদ্দিন ওরফে সামছু ওরফে সমশের উদ্দিনের (৩২) হাতে তুলে দেন। তাঁরা মেয়েটিকে নিয়ে একটি পিকআপে করে সারা দিন বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করেন। পরে বাহুবল উপজেলার মিরপুর বাজারে সানি ফার্নিচার মার্ট নামক দোকানে রাতযাপন করেন। সেখানে ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেন তাঁরা। পরদিন তাঁরা ওই শিক্ষার্থীকে অন্যত্র পাচারের চেষ্টা করেন। এ সময় বাজারের পাহারাদার দেখতে পেয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন। তবে পালিয়ে যান জাহির ও সমশের।
শিক্ষার্থীর বাবা জানান, ধর্ষণের ঘটনার পর মেয়েটিকে নিয়ে তিনি বিদ্যালয়ে যান। মেয়েটিকে আপাতত বিদ্যালয়ে না যাওয়ার পরামর্শ দেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী। পরে তিনি স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বিকে নিয়ে এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ে যোগাযোগ করলে প্রধান শিক্ষক তাঁদেরও একই পরামর্শ দেন। প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে ঘটনার পর থেকে তিনি মেয়েকে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ান। বার্ষিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসায় তিনি মেয়েকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রধান শিক্ষক তাঁকে জানান, বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ ওই ছাত্রীকে ছাড়পত্র দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীকে তিনি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে পারবেন না।
এ ব্যাপারে স্থানীয় মুরুব্বি অরুণ চক্রবর্তী বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীকে স্কুলে লেখাপড়া ও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি স্থানীয় মুরুব্বিদের নিয়ে বিদ্যালয়ে যোগযোগ করেছি। প্রধান শিক্ষক আমাদের বলেছেন, ধর্ষিতা ছাত্রীটিকে বিদ্যালয়ে যেতে দেওয়া হলে এর প্রভাব অন্য শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে তাকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী বলেন, ‘ঘটনার পরপরই বিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ ওই শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্র দিয়ে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই তাকে ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। সত্যিকার অর্থে আমার কিছুই করার ছিল না। বিষয়টা সম্পূর্ণ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপার।’
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাশিম মিয়া বলেন, ‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চাপের মুখে আমরা তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনেক আগে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। একটি কুচক্রী মহল আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এখন শিক্ষার্থীটির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ চাইছে। গত পাঁচ মাসের ভেতরে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের কোনো সদস্য আমাদের স্কুলে আসেনি।’
ঘটনাটি জানাজানি হলে আজ বাহুবলের ইউএনও সাইফুল ইসলাম ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে কথা বলে মেয়েটিকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন।
ইউএনও সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সে জন্য তার প্রতি সদয় থাকা আমাদের দায়িত্ব। যে কোনো কারণেই হোক মেয়েটি যে কয়টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। এ বিষয়টি শিক্ষার্থীর ষান্মাষিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে বিবেচনা করা হবে।’
পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তার করার জন্য ইউএনও বাহুবল থানার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ধর্ষণের ঘটনায় বাহুবল মডেল থানায় মামলা করেন মেয়ের বাবা। পুলিশ জানায়, ফাতেমা ও জাহির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তবে সামছুদ্দিন ওরফে সামছু ওরফে সমশের উদ্দিন এখনো পলাতক।