পরিবহন শ্রমিকই সব, পাবলিক হচ্ছে ফালতু
আড়াই-তিন দিন ধর্মঘট করে মালিক ও মন্ত্রীর মদদপুষ্ট সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা প্রমাণ করে দিল কত ধানে কত চাল, আর সেই চালের কতটা তাদের পকেটে। মজার বিষয় হলো যারা এই শ্রমিকদের চালায় অর্থাৎ মালিকপক্ষ তাদের কেউ সমালোচনা করছে না। তারা সবার ঊর্ধ্বে। শ্রমিকদের যে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ধর্মঘট করা হলো, সেটা কারো নজরে আসল না। যারা ক্ষমতাবান তারা এ রকমই পার পেয়ে যায়। প্রমাণ করে দিল তাদের শক্তি এবং আঙুল তুলে সবাইকে বলল ‘খবরদার’।
ধর্মঘটের তিনদিনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ যারা বাসে চড়ে কাজে যায়, দেশে যায় ও দূরে যায়। সমাজের এই নিম্নপদস্থ মানুষদের দিকে তাকানোর প্রয়োজন কারো হয় না। কারণ তাদের কোনো ক্ষমতা নেই, তারা থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী?
এত উলঙ্গভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষমতাহীনতার মহড়া অনেকদিন দেখা যায়নি। তারা যেকোনো রাজনীতিতে, কোনো চিন্তাভাবনায় কোনো ছায়া ফেলে না, একটি নীরব ও অদৃশ্য জনগোষ্ঠী হয়ে গেছে সেটা আবার প্রমাণিত হলো। জনগণের জন্য কান্নাকাটি করার কোনো মানে হয় না। কারণ সেই কান্না শোনার কোনো লোক নেই, না শুনলেও চলে যারা দেশ চালায় তাদের। জনগণ তো অনেকেই কাঁদল তাতে কি কারো অসুবিধা হলো?
একজন মালিককে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, এই যে জনগণের এত কষ্ট হচ্ছে, তাতে তার কী মনে হয়? তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী যার পরিবহন ক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। তার উত্তরটা যথোপযুক্ত, ‘আরে ভাই পাবলিক মরছে নাকি একটাও, কারো তো কিছু হয় নাই এত কান্দেন ক্যা?’
শ্রমিকদের যতই গালি দেওয়া হোক, গলদটা হচ্ছে পুরোটা খাতের। বাংলাদেশের কালো টাকার রাজধানী পরিবহন খাত। রাজনীতির জন্য পেশি এবং প্রয়োজনে নির্বাচন পর্যন্ত ঘায়েল করার ক্ষমতা এই খাতের রয়েছে। অতএব তাদের এত হালকা-পাতলা ভাবে দেখাটা ঠিক না। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যত টাকা এই খাতে ঢোকে তার অনেকটাই কালো। বস্তুত পক্ষে কারো বাপের বেটার সাহস নেই এটা হিসেব করার কারণ যার ওপরে দায়িত্ব পড়বে তারাও সম্ভবত এর সঙ্গে জড়িত। তাই যেমন আছে চলবে।
আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ ইত্যাদি সবাই কোনো না কোনোভাবে এই খাতে পূঁজি নিয়োগ করেছে। তাই কার এত ঠেকা পড়েছে এদের সঙ্গে লড়তে যাওয়ার। অতএব কে না চাইবে এখানে কালো টাকা ঢালতে যেটা সব সময়ের জন্য নিরাপদ। অতএব যারা এই খাতকে বা দেশের অন্যান্য খাতকে পরিচালনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা আগামীতে দায়িত্ব পাবে তারা সবাই এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এবার কি বোঝা যাচ্ছে কেন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না এই খাতের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে?
যে আদালতের রায়ের প্রতিবাদে এই ধর্মঘট ডাকা হলো তার উদ্দেশ্য কি এই ছিল যে আদালত কতটা দুর্বল সেটা প্রমাণ করা। আদালতের রায় মানুষ অবশ্যই সমালোচনা করতে পারে কিন্তু ধর্মঘট, মিছিল কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না। আমাদের দেশে এমনিতেই ধনকুবেরদের ক্ষমতার চেয়ে আদালতের ক্ষমতা বেশি এমনটা জোর গলায় বলাটা সব সময় সম্ভব না। অতএব আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করার চেয়ে রাস্তায় নেমে হরতাল করাটা অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ এবং সেটাই তারা করেছে তাদের নেতাদের ইঙ্গিতে। কারণ নেতারা জানে তাদের ক্ষমতার দৌড় কত দূর।
সেই দৌড়টা গিয়ে যে বাংলাদেশের সরকারের ক্ষমতাবান দলের মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছাবে এটা কি খুব আশ্চর্য হওয়ার বিষয়? শাজাহান খান দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে আছেন এবং পরিবহন শ্রমিক তাঁর মূল শক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও সবচেয়ে প্রভাবশালী। যেকোনো সরকারের এই পরিবহন শ্রমিকের শক্তি প্রয়োজন, তাই তার পক্ষে এই ধর্মঘটের সমর্থন দেওয়া বা আহ্বান করার পরামর্শ দুই-ই স্বাভাবিক। যে নরম সুরে সরকারের অন্য মন্ত্রীরা এই কর্মসূচির সমালোচনা করেছে তাতে বোঝা যায় যে তাঁরা বোঝেন কার ঘারে কটা মাথা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রীর পরে শাহজাহান খানের অবস্থান। অতএব তাকে যে সবাই হুজুর হুজুর করবে এটাই স্বাভাবিক।
এই খাতের দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথা বলার দরকার নেই। তবে স্বাধীনতার পরে কোনো শ্রমিক সংগঠন এত সবল দেখা যায়নি। যখন একটা সংস্থা এতটা সবল হয় তার কর্মকাণ্ডে এতটা আশকারা দেওয়া তখন তাদের এই ধর্মঘট করাটা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রয়োজন, অতএব তারা যেটা চাইছে সেটাই হবে।
এই ফালতুর মধ্যে আম পাবলিক পড়ে। এই আম পাবলিকের উচিত কান্নাকাটি না করে পদব্রজে ভ্রমণের প্র্যাক্টিসটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাদের কথা শোনার কারো সময় নেই, আল্লাহই জানে তাদের ভোটের প্রয়োজন আছে কি না।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক