নয়মাস
মুক্তিযুদ্ধ যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র
ইমদাদুল হক মিলনের নতুন উপন্যাস ‘নয়মাস’। ৯৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির দুটি অংশ। যার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বীরাঙ্গনাদের ঘটনা একীভূত। উপন্যাসটি যুব সমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি। এর আখ্যানকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যা ইতিহাসের শুষ্ক পৃষ্ঠার উপকরণ এবং বাস্তব ঘটনার জারকরসে পূর্ণ।
ইমদাদুল হক মিলন ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ উপন্যাসে ব্যতিক্রমী ভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী উপস্থাপন করেছিলেন। অন্যদিকে ‘নয়মাস’ উপন্যাসে লেখকের আত্মজৈবনিক ভঙ্গি আছে কিন্তু তা ‘জিন্দাবাহার’ ও ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ থেকে ভিন্ন। ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’য় (২০১২) ইমদাদুল হক মিলন নিজের বেড়ে ওঠার কথা লিখেছেন। তাঁর গ্রাম, প্রকৃতি, আড়িয়ালবিলের জীবন, মানুষ, ভাষা, হাটবাজার সবই উন্মোচিত হয়েছে সেখানে। একইসঙ্গে আদি ঢাকার সঙ্গে বিক্রমপুরের যোগাযোগ, লেখকের নিজের এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবন, দেশভাগ, দাঙ্গা প্রভৃতি রূপ লাভ করেছে। এই স্মৃতি অভিজ্ঞতার পথ ধরেই তাঁর বাল্য-কৈশোর-যৌবন উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি নিজের সৃজনশীলতার পথে অগ্রসর হয়েছেন। ফলে চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে ইমদাদুল হক মিলন সহানুভূতিশীল, হৃদয়বান, ভাষা সচেতন ও অনুভূতিশীল আখ্যান নির্মাতা। একদিকে গ্রামীণজীবন, মানুষ, প্রকৃতি অন্যদিকে আধুনিক নগর জীবন, প্রেম, যৌনতা তাঁর কথাসাহিত্যের মৌল উপজীব্য।
তবে মুক্তিযুদ্ধ ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। এখানে তাঁর দৃষ্টি ও ভাবনার জগত প্রসারিত; তাঁর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশামগ্ন সমাজের চিত্র একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অন্বেষায় তিনি নির্মোহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গল্পগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। মূলত তিনি নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। ‘রাজাকারতন্ত্র’, ‘কালোঘোড়া’, ‘ঘেরাও’, ‘বালকের অভিমান’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’, ‘একজনা’, ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এসব উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, তাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিন্ন অনুসন্ধানী আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে উপন্যাসগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনার অভিজ্ঞতাকে ইমদাদুল হক মিলন বৃহৎ ক্যানভাসে বিশদ করে তুলেছেন ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’তে। তিন পর্বে ‘নূরজাহান’ রচনায় সাফল্যের পর বড় উপন্যাস সৃষ্টিতে মনোযোগী হন তিনি। তবে ‘নয়মাস’ তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে ব্যতিক্রম।
২.
‘নয়মাসে’র প্রথম অংশে আছে পাকিস্তানি কিশোরী মায়মুনা হায়দার খানের কাহিনী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনে যে নিজে বদলে যায় আর পাকিস্তানে ফেরত যেতে বাধ্য করে পিতামাতাকে। মায়মুনার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তার জবানিতে যথাক্রমে ‘আমি ও বাংলাদেশ’, ‘ইতিহাসের কয়েক পাতা’, ‘দ্বিতীয় পর্ব’, ‘হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের বিবরণ’, ‘আমার সিদ্ধান্ত’, ‘ক্ষমা করো, ক্ষমা করো’- এসব শিরোনামাঙ্কিত অংশে। ‘নয়মাসে’র দ্বিতীয়াংশের নাম ‘ঘা’। পাঁচটি পরিচ্ছেদে লেখকের জার্মানি প্রবাসী বন্ধু মিনহাজের আগমনসূত্রে যে আত্মস্মৃতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে বীর সন্তানদের বিশেষত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে দরদের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
উপন্যাসের প্রথম অংশের সঙ্গে দ্বিতীয় অংশের কাহিনীর যোগসূত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত। প্রথম অংশে মায়মুনা চরিত্র এবং দ্বিতীয় অংশে মিনহাজ প্রাধান্য পেলেও একাত্তরের স্পষ্ট ছবিটি ফুটে উঠেছে পাকিস্তানি পিতা-মাতার সঙ্গে বদলে যাওয়া মায়মুনা চরিত্রের স্বরূপ উদঘাটনে। একজন ১৩ বছরের কিশোরী যার স্কুল এবং খেলাধুলা নিয়ে মাতোয়ারা থাকার কথা তার পরিবর্তন দেখিয়েছেন লেখক ক্রমান্বয়ে। বসুন্ধরার পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকা লেখক ও সম্পাদকের কাছ থেকে বাংলাদেশে একাত্তরে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নির্যাতনের কাহিনী শুনে পাল্টে গেছে মায়মুনা। ঔপন্যাসিক সুন্দর এবং প্রাণবন্ত ও ঘরোয়া পরিবেশের একটি নান্দনিক সজ্জায় ইতিহাসের বয়ান সম্পন্ন করেছেন। যেখানে ব্রিটিশ যুগ থেকে আরম্ভ করে পাকিস্তান সৃষ্টি ও পাকিস্তানি শাসকদের কদাকার চেহারা ফুটে উঠেছে। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানটিও স্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত হয়েছে। একাত্তরের ইতিহাস কীভাবে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে পাল্টে দিতে পারে তার সমুজ্জ্বল চিত্র মায়মুনা চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে। কেবল লেখকের ইতিহাস কথন নয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত ইংরেজি ভাষার বই পড়ে উর্দুভাষী কিশোরী উজ্জীবিত হয়েছে।
‘আমার সিদ্ধান্ত’ অংশে আছে- ‘সেই সন্ধ্যা থেকে আমি বদলাতে শুরু করি।... কিন্তু আমি বদলে যাচ্ছি। নিজের ওপর আমার প্রবল ঘৃণা জন্মাচ্ছে। আমি ওই পাকিস্তান দেশের মেয়ে। পাকিস্তানি! আমার দেহে মনে রক্তে ওই জাতির ধারা।.. .আর কোনোদিনও বাংলাদেশের স্কুলে যাব না। এই ফ্ল্যাট থেকেই আমি বেরোব না। আমি কিচ্ছু করব না। কোনো বাঙালিকে মুখ দেখাব না।’ পাল্টে গিয়ে সে তার পিতামাতাকে বলেছে, ‘আমি এ দেশে থাকব না। দু-চারদিনের মধ্যে আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দাও।’(পৃ ৪৫) ‘ক্ষমা করো, ক্ষমা করো’ অংশে সে আত্মগ্লানি থেকে প্রকাশ করেছে- ‘আমি হত্যাকারী জাতির সন্তান, বিভৎস নারী নির্যাতনকারী জাতির সন্তান, শিশুহত্যাকারী জাতির সন্তান।’ এ কারণে সে ইতিহাস বিবৃতকারী লেখকের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তার ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের প্রথম অংশ সমাপ্ত হয়েছে।
৩.
‘নয়মাসে’র ‘ঘা’ অংশের শুরুতে লেখক আত্মজৈবনিক ভঙ্গিতে মিনহাজ চরিত্র নিয়ে কাহিনী শুরু করেছেন। জার্মানি থেকে নিজের দেশে এসে এই ব্যক্তি লেখককে দেশ নিয়ে অনেক হতাশার কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু লেখক তাকে নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করে দেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তান আমলে দেশ ভালো ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধের পর বর্তমান বাংলাদেশ এখন বহুদূর এগিয়েছে। বাঙালিরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। এজন্য বন্ধুকে তিনি শুভ চিন্তা করতে বলেছেন। আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। লেখকের গ্রামের বাংলো বাড়িতে অবস্থানের সময় রিকশা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে উভয়ে যেমন গ্রাম্য প্রকৃতি-পরিবেশ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের ঘটনা পাঠকদের শুনিয়েছেন। প্রকৃতির বর্ণনা আছে এরকম-‘ফাগুন মাসের একটু বেলা হওয়া সময়টা খুব ভালো লাগছে। গাছপালায় কী সুন্দর রোদ, কী সুন্দর হাওয়া! এই হাওয়াকে বলে বসন্তকালের হাওয়া। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। হাওয়ায় ফুলের গন্ধ। নিজের গাছপালাগুলোর দিকে তাকালে প্রায়ই আমার মনে হয়, গাছপালার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই পৃথিবীতে।’(পৃ ৬৮)
বিশেষত ‘একাত্তরে যে ঘা ওরা আমাদের জীবনে রেখে গেছে, সেই ঘা আমাদের সারা জীবন কষ্ট দেবে। সেই কষ্টের ইতিহাস, বেদনা-বীভৎসতার ইতিহাস আমরা ভুলতে পারব না।’(পৃ ৭১) এজন্য তৃতীয় পরিচ্ছেদে বীরাঙ্গনা রাসুর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে লেখক ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করেন। তাকে কেন্দ্র করে ফ্ল্যাশব্যাকে লেখক মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম তৈরি হয় এবং নয়মাস পর দেশ স্বাধীন হয়। তার পর রাসু কর্মকারদের আরেক যুদ্ধ করতে করতে জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হতে হয়েছে। নির্যাতনের অপবাদ মাথায় নিয়ে যে জীবন-যাপন করতে হয়েছে সেখানে সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের ভূমিকাও লেখক দেখিয়েছেন। তিনি নিজে আর্থিক সহায়তা করে বীরাঙ্গনাদের ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছেন। ‘বিকেল হয়ে আসা রোদ গাছতলায় পৌঁছতে পারেনি। বেশ আরামদায়ক একটা ছায়া পড়ে আছে। বয়স্ক একজন রিকশাঅলা রিকশার সিটে বসে পা মেলে দিয়েছে চালকের ছোট্ট বসার জায়গায়।’(পৃ ৮৫)- এই রিকশা চালককে উপন্যাসের শেষে আমরা আবিষ্কার করি একজন বীরাঙ্গনার স্বামী হিসেবে। তাজবিবিকে উদ্ধারের পর নিরন্তর সেবা করে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টাকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষের স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তার আগে লেখক মিনহাজকে তাজবিবির ঘটনা শুনিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ফুলমতি, নূরজাহান, ফুলজান, জোহরা, লাইলি, রাহেলা, দীপ্তি রানী, মালেকা, খুকি বেগম, লক্ষ্মী রানী, এসনু বেগম, আদিবাসী চাইন্দাউ মারমা প্রভৃতি বীরাঙ্গনার নামও শুনিয়েছেন সম্মান জানানোর জন্য। তাজবিবি ও রিকশা চালক রমজানের কুঁড়ে ঘর লেখকের বর্ণনায় চিত্রিত হয়েছে এভাবে- ‘ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর। এক পাশে ছোট রান্নাচালা। দু-তিনটা আম জাম আর তেঁতুলগাছ আছে বাড়িতে। একটা বাঁশঝাড় আছে। ফাগুন মাসের দুপুরবেলার রোদে ঝিম ধরে আছে চারদিক। বাঁশঝাড় শনশন করছে হাওয়ায়। কী একটা পাখি থেকে থেকে শিস দিচ্ছে।’(পৃ ৯৫) এই তাজবিবির সঙ্গে সাক্ষাতের পর মিনহাজের রূপান্তর ঘটল। তিনি বীরাঙ্গনার পা জড়িয়ে ধরে দেশমাতৃকার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বলেছেন-‘আপনারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন।’(পৃ ৯৬)
৪.
‘নয়মাস’ উপন্যাসে প্রথম থেকে যে করুণ সুর বেজে চলেছে তার আপাত পরিসমাপ্তি হয়েছে তাজবিবি-রমজানকে মিনহাজের সহায়তার হাত প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে। ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন দেশের মধ্যে এ রকম অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থাকার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তার জন্য দরকার বোধের পরিবর্তন, চেতনার প্রসারণ। পাকিস্তানি কিশোরী আর প্রবাসী বাংলাদেশি উভয়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক কাহিনী শেষ করেছেন ‘নয়মাসে’র। এ উপন্যাসের ভাষা সাবলিল, উপমা ও চিত্রকল্প ইমদাদুল হক মিলনের গদ্যরীতির স্বাভাবিক প্রবণতা। কাহিনীর সূচনা এবং সমাপ্তিতে কাব্যিক ব্যঞ্জনা রয়েছে। সর্বোপরি ইতিবাচক বাংলাদেশকে জানতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন প্রজন্মের ভেতর ছড়িয়ে দিতে ‘নয়মাসে’র আখ্যানবস্তুর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
বই পরিচিতি
নয়মাস
ইমদাদুল হক মিলন
অনন্যা প্রকাশ (২০১৭)
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
মূল্য : ১৭৫ টাকা