শঙ্খচিলের শহীদ কাদরী, ঘরে ফেরার দীর্ঘশ্বাস
‘তোমার আমার প্রিয় কবি কোথায় যেন বলেছিলেন—
সব পাখিরা ঘরে ফেরে,
সব নদী।
আমরা কেন দণ্ডায়মান গাছতলাতে নিরবধি।
কীর্তিনাশার কালোস্রোতে
নৌকো ভাসে সারি সারি,
এবার আমি বলতে পারি—
যাচ্ছি বাড়ি।
যাচ্ছি বাড়ি’।
(সব নদী ঘরে ফেরেঃ শহীদ কাদরী)
শহীদ কাদরী। ৭৪ বছরের একটি জীবন কেটে গেল বাড়ি ফেরার অতৃপ্ত তাড়নায়। ১০ বছর বয়সে সময়ের ঝাপটায় ঘর ছেড়েছিলেন। আর সেই থেকে কবিতার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন একটি সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে। বোহেমিয়ান এক বাউণ্ডুলে জীবন ফুরিয়ে চুয়াত্তর বছর বয়সে ফিরে এলেন ঘরে।
শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা ‘শঙ্খচিল’-এর শহীদ কাদরী সংখ্যার পুরোটা জুড়েই আমি টের পেয়েছি একটি ৭৪ বছরের জীবন, চলছে ফিরছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আমি স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি ১০ বছরের একটি বালক ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে দৌড়ে বড় বড় সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে যাচ্ছে পার্ক সার্কাসের প্রিয় বাড়িটার দোতলায়। আর চক দিয়ে দেয়ালের প্রতিটি জায়গায় লিখছে—শহীদ কাদরী, শহীদ কাদরী...।
শহীদ কাদরীর প্রয়াণের তিন মাস পূর্বে শুরু হয়েছিল শঙ্খচিল শহীদ কাদরী সংখ্যার কাজ। তেমনটিই জানতে পারলাম সংখ্যার শুরুতেই সংযুক্ত শহীদ কাদরীকে লেখা শঙ্খচিলের চিঠি পড়ে। আট লাইনের সম্পাদকীয়তে আছে ৩৫২ পৃষ্ঠার কৈফিয়ত। সূচিপত্রের ওপর দিয়ে একটি নদী ধীরে ধীরে ফিরে আসছে ঘরে আর ঢুকে যাচ্ছে আমাদের বোধের বারান্দায়।
‘শহীদ কাদরী সাহেব সুখী হতে চেয়েছিলেন’, সুহৃদ-বন্ধু আল মাহমুদের এমন আখ্যানেই শুরু হয়েছে সংখ্যার মূল আয়োজন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন তাঁদের ‘প্রথম ও শেষ দেখা’র গল্প। আছে কবিপত্নী নীরা কাদরী, ভাতুষ্পুত্রী সাদাফ ও সীমন কাদরীর বাল্যস্মৃতি। স্মৃতিচারণ করেছেন হেলাল হাফিজ, কবীর সুমন, আখতার হুসেন, হাসান আল আবদুল্লাহ, কবির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. আমর আশরাফ প্রমুখ।
‘জলছায়া’ বিভাগে হুমায়ূন আহমেদের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ গল্পে উঠে এসেছে শহীদ কাদরী। আছে মফিদুল হকের মূল্যায়নধর্মী স্মৃতিচারণা। শহীদ কাদরীর বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত কিংবা প্রবাসী। দীর্ঘদিন মার্কিন মুলুকে থাকায় কবিকে দেখতে পাননি অনেকেই। এ বিভাগে তরুণ কবিদের লেখায় তাই ঘোরাফেরা করেন একজন অন্য রকম তরুণ শহীদ কাদরী।
শহীদ কাদরী আর আড্ডা যেন একে অন্যের পরিপূরক। তুখোড় আড্ডায় দিন-রাত এক করে ফেলার অজস্র স্মৃতি এখনো লেপ্টে আছে ঢাকার রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয়, বিউটি বোর্ডিংয়ের উঠোনে। তাই শহীদ কাদরীর কথা এলে আড্ডার কথা আসে। শঙ্খচিলের ‘আড্ডা’ বিভাগটি তাই একটু বেশিই জীবন্ত মনে হয়। নিউইয়র্কে বসে শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক আড্ডা দিচ্ছেন আর আমি যেন নীরবে ঢুকে পড়ছি তাঁদের আড্ডায়। এ বিভাগে আরো আছে বেলাল চৌধুরী, শিহাব সরকার ও ইকবাল হাসানের আড্ডার গল্প। আছে ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’র পেছনের কথা।
সাক্ষাৎকার বিভাগে রয়েছে আদনান সৈয়দের নেওয়া শহীদ কাদরীকে নিয়ে মাহমুদুল হকের স্মৃতিচারণা। যেখানে মাহমুদুল হক বলেছেন, ‘আমি যা কিছু শিখেছি তা শহীদের জন্যই।’ এ ছাড়া কবি তমিজ উদদীন লোদীর সাক্ষাৎকারটিও বিশেষ গুরুত্ববহ। শহীদ কাদরীর আরো সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামস আল মমীন ও শিখা আহমেদ।
কবিতা অংশে রয়েছে ২১টি নিবেদিত কবিতা, দুটি দীর্ঘ কবিতা ও দুটি সনেট। ‘চিত্রকাব্য’ বিভাগটি সংখ্যার এক অনন্য সংযোজন। রয়েছে কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মাসুক হেলালসহ আটজন শিল্পীর আঁকা কবির প্রতিকৃতি।
‘চিত্রকথা’ বিভাগে নাসির আলী মামুনের লেখাটি কিছুক্ষণের জন্য যেন ঘুরিয়ে আনল সুদূর আটলান্টিকের তীরে। সংগীত বিভাগে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ নিয়ে কবীর সুমনের লেখাটি নিয়ে যায় অন্য জগতে।
কবির কবিতা নিয়ে অনুগল্পের বিষয়টি সত্যিই ভিন্ন এক আয়োজন। ভালো লেগেছে মুম রহমান, আফসানা বেগম ও আনজুম সানির অনুগল্প।
অনু হোসেনের মূল্যায়নধর্মী লেখাটিতে সহজ বিশ্লেষণে একসঙ্গে উঠে এসেছে শহীদ কাদরীর কবিতা ও কবিজীবনের নানা দিক। মূল্যায়ন বিভাগে আরো রয়েছে কায়সার হক, বায়তুল্লাহ কাদেরী, আহমাদ মোস্তফা কামাল, নিপা জাহান, আঁখি সিদ্দিকা, মুহাম্মদ ইমদাদ, কিশোর ঘোষ, পলিয়ার ওয়াহিদ, মঈন মুনতাসীর ও সজল আহমেদের রচনা। শহীদ কাদরী জীবনে চিঠি লিখেছেন খুব কম। তবে শঙ্খচিলের ‘ডাকঘর’ বিভাগে প্রয়াত কবিকে লেখা চিঠিগুলো পড়ে একটি গুমোট কান্না যেন দলা পাকিয়ে গেল। ‘ডাকঘর’ বিভাগটি যেন পুরো পত্রিকাটি পড়ার আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিল।
শঙ্খচিলের বিষয়-বিন্যাস ও নান্দনিকতা পাঠককে কৌতূহলী করবে। বিশেষভাবে ভালো লেগেছে প্রতিটি বিভাগের শুরুতে কবির একটুকরো কথা আর ছবি। প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত উল্টালে দেখা যায় একজন শিশু শহীদ কাদরী একটু একটু করে বড় হচ্ছেন। সংখ্যাটিতে তরুণদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। প্রচ্ছদে যেন এক তরুণ শহীদ কাদরীকে পরিচয় করিয়ে দিল শঙ্খচিল।
মাহফুজ পাঠক ও ইকবাল মাহফুজ সম্পাদকদ্বয়কে ধন্যবাদ দিতে হয় এমন শ্রম সাপেক্ষ কাজ করার জন্য। কবি রিফাত চৌধুরীর গদ্যের ভাষায় বলব—‘কাদরী আপনাকে সুপ্রভাত! সালামালেকুম! নমস্তে! গুডমর্নিং, স্মরণিং!’
শঙ্খচিল (শহীদ কাদরী সংখ্যা)
সংখ্যা ৪। বর্ষ ৫। জানুয়ারি ২০১৭
সম্পাদক : মাহফুজ পাঠক ও ইকবাল মাহফুজ
প্রচ্ছদ ও নামলিপি : সব্যসাচী হাজরা
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত প্রতিকৃতি : বিপ্লব সরকার
অলংকরণ : মোস্তাফিজ কারিগর, রাজীব দত্ত, আলমগীর জুয়েল
শিল্পসজ্জা : ফারুক মুহাম্মদ
মূল্য : ১৫০ টাকা। ৩৫২ পৃষ্ঠা।