জন্ম বস্তিতে, পড়তেও পারেননি, এখন ধনকুবের
ব্যাং জুং ইয়কের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বস্তিতে। আর দশটা বস্তির ছেলের মতোই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। দারিদ্র্য ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে স্কুলজীবনটা কোনোভাবে শেষ করতে পারলেও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার আগেই শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়েছে ব্যাংকে।
ব্যাং সব সময়ই নতুন প্রজন্মের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রযুক্তিকেন্দ্রিক কয়েকটি উদ্যোগ নেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তবু নিজেকে কখনোই থামিয়ে দেননি ব্যাং, বরং লড়াই করে গেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে মাত্র আটজন কর্মচারী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি নেটমারবেল গেমস করপোরেশন। আর এর মধ্য দিয়েই তাঁর শ্রম-মেধা-ধৈর্য যেন সফলতার চূঁড়ায় পৌঁছার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এই কোম্পানি থেকে প্রথমে তিনি লিনেজ-২ ও মারভেল ফিউচার ফাইট নামে দুটি গেম বাজারে আনেন। এগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এর পর যেন আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ব্যাংকে।
স্যামসাং, হুন্দাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। বেশি করে গৃহস্থালি আর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে তাঁরা বৈশ্বিকভাবে টিকে থাকতে। ঠিক তখনই ব্যাংয়ের কোম্পানি স্মার্টফোন গেমের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেন। ঠিক যেমনটা নতুন প্রজন্ম চাইছিল। ফলে অতিদ্রুত গেম বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে নেটমারবেল। এই প্রচেষ্টায় পাশে পায় চীনা কোম্পানি টিসেন্ট হোল্ডিং লিমিটেডকে। ২০১৪ সালে চীনা কোম্পানিটি ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে ব্যাংয়ের কোম্পানিতে।
ব্লুমবার্গ ইন্টিলিজেন্সের কর্মকর্তা অ্যানথিয়া লেই বলেন, ‘ব্যাংয়ের যোগ্যতাই তাঁকে বিদেশি বড় ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পেতে সহায়তা করেছে। নেটমারবেলের এই সাফল্যের পেছনে টিসেন্টের এর বড় ভূমিকা রয়েছে।’
‘ব্যাং প্রমাণ করে দিয়েছেন, তাঁর বাজার দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুনেই নেটমারবেল আজ এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে’, যোগ করেন অ্যানথিয়া লেই।
ব্লুমবার্গ বিলিনিয়র ইনডেক্স অনুযায়ী, নেটমারবেলে ব্যাংয়ের মালিকানা ছিল ২৪ দশমিক ৫ ভাগ। শেয়ারবাজারে আসার পর ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) থেকে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার লাভ করে। অবশ্য ব্যাং নিজে কিংবা তাঁর প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
প্রকাশক হিসেবে প্রথম দিকে নেটমারবেল অন্য গেম নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিজ্ঞাপন, বিপণন ও বিতরণের কাজ করত। যখন আইপিও থেকে মূলধনের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখন তারা বিনিয়োগ চুক্তির জন্য অংশীদারের খোঁজ শুরু করে।
ব্লুমবার্গের মতে, ৪৮ বছর বয়সী ব্যাং কখনো কলেজে যাননি। তাঁকে স্টিভ জবসের সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে, যিনিও ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্যাং অবশ্য ২০০৬ সালে ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন। স্থানীয় কফির দোকানের শেয়ারও কিনেছিলেন তিনি।
মাঝখানে কিছুদিন ব্যাং নেটমারবেল থেকে দূরে ছিলেন। সে সময়টা নেটমারবেলকে টিকে থাকার জন্য এক ধরনের যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। তাদের গেমগুলো বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। তিনি আবার ২০১১ সালে নেটমারবেলে ফিরে আসেন। আবারো নতুন করে নেটমারবেলকে গোছানোর কাজ শুরু করেন।
যদিও ব্যাংয়ের মনোভাব আর তাঁর নেটমারবেলের কাজের পরিবেশ নিয়ে নানা কথা আছে। কিন্তু ব্যাংকে তা টলাতে পারেনি। ২৪ ঘণ্টা, সাতদিন কাজ করার সংস্কৃতি চালু করেন ব্যাং। তিনি কঠোর পরিশ্রমের ওপর গুরুত্ব দেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো তাঁকে কর্মীদের ওপর নিপীড়নকারী বলে অ্যাখ্যা দেয়। এভাবে চার বছর কেটে যায়।
অপরদিকে তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহীদের কাছে নেটমারবেল ছিল অনেকটা ‘বাতিঘরের’ মতো। বলে থাকেন। কারণ সবাই যখন ঘুমিয়ে যেত তখনো তাদের কাজ চলত।
নেটমারবেল ও ব্যাংয়ের সাফল্যের গল্প নতুন প্রজন্মকে অণুপ্রাণিত করবে। অপরদিকে বড় বড় করপোরেট করপোরেশনের আধিপত্যে থাকা দেশগুলোর মেধাবীদের নতুনের পথ দেখাবে।
ব্লুমবার্গ ইন্টিলিজেন্স কর্মকর্তা লেই মনে করেন, নেটমারবেলের উত্থান এবং এর প্রতিষ্ঠাতার সফলতার গল্প তথ্য-প্রযুক্তি খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহিত করবে।’
শুক্রবার নেটমারবেল শেয়ারবাজার থেকে ২ দশমিক ৬৬ ট্রিলিয়ন ওন (দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা) আয় করে। এতে কোম্পানির মূল্য বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩ ট্রিলিয়ন ওন। এই মূলধন এলজি ইলেক্ট্রনিক্সের মতো জায়ান্ট কোম্পানির বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি।