সেলফিতর্ক
ফের আলোচনায় সেলফি। রাজধানীর বনানীতে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার আলোচিত আসামি আবদুল হালিম ওরফে নাঈম আশরাফের সঙ্গে কিছু সেলিব্রিটি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সেলফি নিয়ে তর্কটা শুরু হয়েছে। এর আগে সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তারকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে সমালোচিত হয়েছিলেন একজন নারী সংসদ সদস্য।
প্রতিদিন কত লোক কত লোকের সঙ্গে ছবি তোলে, সেলফি তোলে এবং তা ফেসবুকে দেয়। একজন খারাপ লোকও ভালো লোকের সঙ্গে সেলফি তুলতে পারে। অনেক সময় অখ্যাতরা বিখ্যাতদের সঙ্গে সেলফি তুলে সেটি ফেসবুকে দিয়ে নিজের স্ট্যাটাস বাড়াতে চায়। অনেক সময় যিনি সেলফি তুলতে চান, তাঁকে নিষেধ করা যায় না চক্ষুলজ্জায়।
ধরা যাক, আপনি একজন সেলিব্রিটি, অধ্যাপক, বিশিষ্ট সাংবাদিক, তারকা অথবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। কোনো একটি অনুষ্ঠানে গেলেন। আপনার পরিচিত, অল্প পরিচিত এমনকি অপরিচিত কেউ এসেও যদি আপনার সঙ্গে ছবি অথবা সেলফি তুলতে চায়, আপনি কি বারণ করবেন? অনেক সময়ই এটা সম্ভব হয় না। কিন্তু দেখা গেল আপনি যাদের সঙ্গে সেলফি তুললেন বা যারা আপনার সঙ্গে ছবি তুলল, তাদের মধ্যে কেউ পরবর্তী সময়ে কোনো অপরাধে গ্রেপ্তার হলো বা বিতর্কিত হলো। এখন ওই লোকের অপরাধে কি আপনাকে অপরাধী বলা যাবে?
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও অনেক খারাপ লোকের ছবি আছে। সে জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করতে পারি না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো নিরেট ভদ্র মানুষ এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সঙ্গে কোনো খারাপ বা বিতর্কিত লোকের ছবি থাকতে পারে, সেই ছবি স্যার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়তো তুলেছেন, সে কারণে আমরা এই প্রশ্ন তুলতে পারি না যে, স্যার অমুকের সঙ্গে ছবি কেন তুললেন?
এবারের আলোচনাটি আসছে এ কারণে যে, যেহেতু নাঈম আশরাফের নানা কুকীর্তির কথা এরই মধ্যে ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং আদালতে বিচারের আগেই তার একরকম মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেছে, ফলে তার সঙ্গে যাঁদের ছবি ও সেলফি প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরাও আলোচনায় আসছেন। কেননা, ধরে নেওয়া হচ্ছে যে নাঈমের সঙ্গে তাঁদের সখ্য ছিল বা আছে। কারো কারো সঙ্গে খুব হাস্যোজ্জ্বল ছবিও দেখা যাচ্ছে।
বিষয়টা হলো, নাঈম যে ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যুক্ত, সেখানে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বিশেষ করে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তার সখ্য বা সম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক। তাঁরা সবাই যে নাঈমের খারাপ দিকগুলো জানতেন, এমনটা নাও হতে পারে। বনানীর ঘটনা জানাজানি হওয়ার আগে নিশ্চয়ই তাঁদের কাছে নাঈম অপরাধী ছিল না। ফলে তার সঙ্গে সেলফি বা ছবি তুলে তাঁরা কোনো অপরাধ করেননি এবং এ কারণে তাঁদের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই।
শোনা যাচ্ছে, একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাকরি চলে গেছে নাঈম আশরাফের সঙ্গে তোলা ছবি ভাইরাল হওয়ায়। আসলেই এ কারণে তাঁর চাকরি গেছে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে তা আমরা জানি না। তবে যদি তাঁর চাকরিচ্যুতির পেছনে আসলেই নাঈমের সঙ্গে ছবির কোনো দায় থাকে, সেটি দুঃখজনক। কারণ যে কারোর সঙ্গেই যে কারোর সেলফি বা ছবি থাকতে পারে এবং সেটি ফেসবুকে আপলোড করা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়।
আমরা স্মরণ করতে পারি, বছর কয়েক আগে পুলিশ একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছে একজন সিনিয়র সাংবাদিকের ভিজিটিং কার্ড পাওয়া গিয়েছিল। তখন ওই সাংবাদিককে কেউ কেউ বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছিলেন। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকরা যখন মাঠেঘাটে, দেশে-বিদেশে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান, তাঁদের সঙ্গে বহু মানুষের পরিচয় হয়। কথা হয়। সৌজন্যের খাতিরেই তাঁরা ভিজিটিং কার্ড বিনিময় করেন। কেউ হয়তো সাংবাদিকের পরিচয় জেনে তাঁর কাছ থেকে কার্ড চেয়ে নেন। একজন সাংবাদিক এভাবে কত শত বা কত হাজার লোককে তাঁর কার্ড দিয়েছেন, তার হিসাব থাকে না। ওই কার্ড নেওয়া লোকজনের মধ্যে অনেক খারাপ, বিতর্কিত এমনকি খুনিও থাকতে পারে। এখন খুনের মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তার পকেট সার্চ করে পুলিশ যদি কোনো বিখ্যাত সাংবাদিকের বা কোনো মন্ত্রীর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভিজিটিং কার্ড পায়, তাতে কি এটা প্রমাণিত হবে যে, ওই খুনির সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে?
মানুষ কেন সেলফি তোলে? নানাভাবে এর জবাব দেওয়া যায়। তবে যে মতটি প্রবল তা হলো, নিজেকে প্রকাশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজের ক্ষমতার প্রকাশ। যেমন একজন ক্ষমতাহীন লোক কোনো একজন ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে সেলফি তুলে সেটি ফেসবুকে আপলোড করে তার পরিচিতজনদের এটা দেখাতে চায় যে, অমুকের সঙ্গে তার সখ্য আছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি তুলেও অনেকে আপলোড করেন। এখানে তিনি দেখাতে চান যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। কেউ কেউ এরকম সেলফি ও ছবি নানা ধান্দাবাজিতেও ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রদূত, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজি- এ রকম ক্ষমতাবানদের সঙ্গেও আমরা লোকজনের সেলফি দেখি। যাঁরা এসব সেলফি ফেসবুকে দেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য থাকে অন্যকে দেখানো যে, এসব ক্ষমতাবানের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে। নাঈম আশরাফের মতো ধূর্ত ও ধুরন্দর লোকেরা এই কাজটি আরো বেশি করবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে ছবি বা সেলফি তুলবে, তাঁদের দোষারোপ করাটা অন্যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।