গণমাধ্যম
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ৫ বছর
টেলিভিশন বা কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বর্ষপূর্তি কিংবা জন্মদিন পালন দর্শক-পাঠক-শ্রোতার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। বরং তারা টেলিভিশনের পর্দায়, পত্রিকার পাতায় এবং রেডিওতে যে ধরনের খবর ও অনুষ্ঠান দেখতে, পড়তে এবং শুনতে চায়, সেই চাহিদার কতটুকু গণমাধ্যম পূরণ করতে পারছে, মানুষের কাছে সেটিই বিবেচ্য। অর্থাৎ গণমাধ্যম আসলেই জনগণের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছে নাকি সে করপোরেট পুঁজি আর বিজ্ঞাপনের স্টিমরোলারের নিচে নিজের স্বকীয়তা বিকিয়ে দিচ্ছে, সেটি একটি বড় বিতর্কের জায়গা এবং এই জায়গায় নিশ্চয়ই এরইমধ্যে অগণিত প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি হয়েছে।
এ রকম একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা যখন ২৪ মে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোনো একটি নিবন্ধ লেখার উদ্যোগ নিই, তখন আমাদের মাথায় রাখতে হয় দেশে এখন ২৫টির বেশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। সবশেষ বাংলা টিভি নামে আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেল যুক্ত হয়েছে এই বহরে।
এসব টেলিভিশনের মধ্যে কে নম্বর ওয়ান, কার খবর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য, কার টকশো মানুষ বেশি দেখে, কোন টেলিভিশনের নাটক ভালো, কারা বিজ্ঞাপন কম দিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে, কে আগে ব্রেকিং নিউজ দিল ইত্যাদি নিয়ে সাধারণ মানুষ কোনো গবেষণা করে না। তার সেই সময় বা প্রয়োজন কোনোটাই নেই। বরং রিমোটের কন্ট্রোল তার নিজের হাতে। যখন যে চ্যানেলে তার চোখ আটকে যায়, সে সেটিই দেখে। সন্ধ্যা ৭টায় সে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে সংবাদ দেখবে নাকি অ্যানিমেল প্ল্যানেটে বাঘের দৌড়ানি, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক দর্শক। এমনকি সে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখবে নাকি ভারতীয়-সে বিষয়েও দর্শকের উপরে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
তবে কার খবর বা অনুষ্ঠান কত জনপ্রিয় তার একটি হিসাব প্রয়োজন হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের। কিন্তু তারা কীভাবে বুঝবেন যে কাদের খবর বা অনুষ্ঠান মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখে? টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) নামে এর একটি পদ্ধতি রয়েছে, যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় কোন সপ্তাহে কোন টেলিভিশন চ্যানেলের কোন অনুষ্ঠানের দর্শকপ্রিয়তা কেমন ছিল? যদিও এই টিআরপি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে এবং সঠিকভাবে রেটিং করা হয় না এমনকি এটি কোনো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিও নয়- এমন সমালোচনাও রয়েছে। কিন্তু যেহেতু টেলিভিশনের রেটিং নির্ধারণের জন্য এর বিকল্প কোনো পদ্ধতি নেই এবং যেহেতু বিজ্ঞাপনদাতারা এটির ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নেন, ফলে টিআরপি নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, এখানে বিভিন্ন টেলিভিশনের সঙ্গে টিআরপি নির্ধারণ কর্তৃপক্ষের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের যত অভিযোগই থাকুক, আখেরে এটিকে মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই।
তবে আমরা এই টিআরপির বাইরে গিয়ে যদি একনজরে দেখার চেষ্টা করি গত ৫ বছরে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর তার দর্শকের জন্য আসলে কী করেছে এবং গণমাধ্যম হিসেবে সে আসলে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, সেখানে একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ আমাদের প্রয়োজন হবে। সেইসাথে আমাদের এই আত্মসমালোচনাটুকুও করা উচিত হবে যে, আমাদের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জগুলোই বা কী?
দর্শকের মনে থাকার কথা, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর শুরুতে মিশ্র চ্যানেল ছিল। অর্থাৎ সংবাদের পাশাপশি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যেমন নাটকও প্রচার করত। কিন্তু এই চ্যানেলকে ব্রেকথ্রু এনে দেয় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ওইদিন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর তাদের অব্যাহত লাইভ সম্প্রচারের কারণে। শুধু লাইভ নয়, লাইভে ওই সময়ে যে রিপোর্টার, প্রডিউসারসহ অন্যান্য কর্মীরা কাজ করেছেন, তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেশের মানুষের সামনে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। বস্তুত এই ঘটনার পরেই চ্যানেল টোয়েন্টিফোর পুরোপুরি সংবাদভিত্তিক চ্যানেলে রূপ নেয়।
রানা প্লাজার পরও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি ঘটনায় নিজস্বতা বজায় রেখে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর তাদের সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান নির্মাণ করলেও তিনটি বিষয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যেমন বছরের পর বছর বিনাবিচারে কারাবন্দি মানুষদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে দেশের প্রতিটি কারাগারে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, কোন কারাগারে কতজন এ রকম বিনা বিচারে বন্দি আছে। শুধু তাই নয়, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ধারাবাহিক রিপোর্টের কারণে এইরমধ্যে অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। নিষ্পত্তির পথে ৫৮টি মামলা। খালাস পেয়েছেন অন্তত ১০ জন। হাইকোর্ট তাঁর এক আদেশে এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি বিরল ঘটনা।
দর্শকরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেন, প্রতিদিন বিকাল ৪টা এবং রাত ১০টার খবরে মানবিক সংবাদ নামে একটি স্টোরি প্রচার করে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে চলা এই প্রতিবেদনগুলোয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গরিব, অসহায় সেসব মানুষের গল্প তুলে আনা হয়, যারা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আর এসব রিপোর্ট দেখে এরইমধ্যে অনেকের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন হাসপাতাল, এগিয়ে এসেছে বিত্তবানরাও।
সবশেষ যখন হাওরে বাঁধ ভেঙে অকাল বন্যায় হাজার হাজার একর ফসলের জমি তলিয়ে গেল, সেই খবর সব টেলিভিশন চ্যানেলই প্রচার করেছে। কিন্তু এই ইস্যুতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর শুরু থেকেই অনেক বেশি সরব ছিল এবং যেদিন বাঁধ ভেঙে শনির হাওর ডুবে যায়, সেই ভয়াবহ ছবি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। বস্তুত ওই ঘটনার পরই সরকারও নড়েচড়ে বসে। হাওর পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের বক্তব্য ও অবস্থান বদলে যায়।
সাম্প্রতিক অন্তত এই তিনটি ঘটনাই প্রমাণ করে, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর গণমানুষের কাছে যেতে পেরেছে এবং যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতেই কি আমরা তৃপ্ত? নিশ্চয়ই না। প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেরই কিছু না কিছু সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা কি দাবি করতে পারি যে, আমরা আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোয় পুরোপুরি পেশাদারত্বের চর্চা করি? টেলিভিশনের কর্মীদের জন্য এখনো কোনো বেতন কাঠামো বা ওয়েজবোর্ড নির্ধারণ করা যায়নি। তথ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন এটা হবে। আমরা আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে কি যথেষ্ট মানবিক এবং নারী সহকর্মীবান্ধব করে গড়ে তুলতে পেরেছি? ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কি সব প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে? বেতনের বাইরে নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্য আর্থিক নিশ্চয়তা, জব সিকিউরিটি বা চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কি আমাদের এখনো অসন্তুষ্টি নেই? কিন্তু তারপরও আমরা বলি, মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমে একজন সাংবাদিককেই ফোন করে। মানুষের জন্য এখনো এই ভরসার পিদিমটুকু জ্বালিয়ে রেখেছে গণমাধ্যম। তবে সেই পিদিম যাতে ঝড়-ঝঞ্ঝায় না নেভে, সেজন্য সরকার, মালিক এবং বিজ্ঞাপনদাতারা আরো আন্তরিক হবেন, এই প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
লেখক : সাংবাদিক