অভিমত
শ্যামল কান্তিরা আজও অসহায়
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত গত শুক্রবার সকালে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে অভিযোগ করেছেন, পরিবারসহ তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। এ জন্য তিনি দায়ী করছেন নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্য আলোচিত এমপি সেলিম ওসমানকে। শ্যামল কান্তির দাবি, কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানোর পর সেলিম ওসমানের ইন্ধনে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মামলা করানো হয় এবং সেই মামলায় তাঁকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর এখন তাঁকে পরিবারসহ দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
এর দুদিন আগে বুধবার বিকেলে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শ্যামল কান্তি সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং তাঁর যদি কিছু হয়ে যায় (প্রাণহানি বা গুম) তাহলে এর জন্য ওসমান পরিবার দায়ী থাকবে বলে মন্তব্য করেন।
পাঠকের মনে থাকার কথা, গত বছরের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জে পিয়ার সাত্তার আবদুল লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে লাঞ্ছিত করেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান। শ্যামল কান্তি ভক্ত এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু পুলিশ প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে হাইকোর্ট পুরো ঘটনার বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেন। ২২ জানুয়ারি বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ জে বি এম হাসানের বেঞ্চ বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে জিডিসহ বিচারিক নথি অবিলম্বে ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে আদালতের নির্দেশে সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি নিয়মিত মামলা করা হয়। এ মামলায় সেলিম ওসমান জামিনে রয়েছেন। যেদিন সেলিম ওসমান জামিন পেয়েছেন, তাঁর পরদিনই ঘুষ গ্রহণের মামলায় শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং ওই দিন বিকেলে আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলেও তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ জেলে থাকার পর শ্যামল কান্তি জামিনে মুক্ত হন।
স্বাধীনতার পরে আশির দশক পর্যন্ত দেশে যাঁরা ধনী হয়েছেন, অসুন্ধান করলে দেখা যাবে তাঁদের অনেকেই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এ দেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, জমি-জমা এবং দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে। অনেক হিন্দু এ দেশে অনিরাপদ বোধ করে সহায়সম্বল বিক্রি করে ভারতে চলে গেছেন। আবার অনেককে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেককে টাকা-পয়সা না দিয়েই জমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। সারা পৃথিবীর সংখ্যালঘুদেরই কমবেশি একই রকম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও আমরা বরাবরই দাবি করার চেষ্টা করি যে বাংলাদেশ খুবই অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা আর এই কেতাবি কথা যে এক নয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে ভূরি ভূরি আছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সম্ভবত শ্যামল কান্তি।
শ্যামল কান্তি যে সমাজে এবং যে ধরনের বাস্তবতার ভেতরে বেড়ে উঠেছেন এবং এখনো বসবাস করছন, তাতে এত দিন তাঁর বেঁচে থাকারই কথা নয়। হয় তাঁর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা, নয়তো খুন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এখনো এ রকম পরিণতি তাঁকে বরণ করতে হয়নি। কিন্তু তিনি যে এ রকম পরিণতির আশঙ্কা করছেন, সেটি জাতিকে জানানোর জন্য ঢাকায় এসে তাঁকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে। এখন রাষ্ট্র কী করবে? স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে তিনি যে ন্যায়বিচার পাবেন না, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট। কারণ, তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানোর বীভৎস ভিডিও সারা দেশের মানুষ দেখলেও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ আদালতে যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেখানে উল্লেখ করেছে যে ওই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি এবং এমপি সেলিম ওসমানের সম্পৃক্ততা মেলেনি। অথচ কোটি কোটি মানুষ দেখেছে, সেলিম ওসমানের নির্দেশেই শ্যামল কান্তি কান ধরে ওঠবস করছেন। অগণিত উৎসুক মানুষ সেখানে হাততালি দিচ্ছে। যেন একজন শিক্ষক নয়, বরং কোনো এক দাগি আসামির বিচার চলছে।
এ রকম একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরও শ্যামল কান্তি যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেননি, বরং লড়াই চালিয়ে গেছেন, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তবে শ্যামল কান্তি এটা পেরেছেন কেবল উচ্চ আদালত এবং দেশের মানুষ তাঁর পাশে ছিল বলে।
ফেসবুকের প্রতিবাদ ঝড় তোলে সারা দেশে। রাজপথে নেমে আসেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মূলধারার গণমাধ্যমও শ্যামল কান্তির পাশে ছিল। ফলে শ্যামল কান্তি নতুন করে বাঁচার হয়তো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। আদালতের নির্দেশে তাঁকে স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু ফের তাঁকে কথিত ঘুষ গ্রহণের মামলায় জেলে যেতে হয়। তাঁরই স্কুলের একজন শিক্ষক এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন গত বছরের ২৭ জুলাই, যার দুই মাস আগেই শ্যামল কান্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক মোর্শেদা বেগমকে এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষ নেওয়া হয়েছে ২০১৪ সালে। অথচ মামলা হয়েছে দুই বছর পর ২০১৬ সালে। আরো স্পষ্ট করে বললে, এমপি সেলিম ওসমান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার দুই মাস পরে। আগে কেন মামলা হলো না? কেন ওই শিক্ষকক তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন না? ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ সে সময় স্কুল শীতকালীন ১৫ দিনের বন্ধ ছিল।
সাংবাদিকদের অনুসন্ধান বলছে, শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ওই স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অপবাদ দেওয়া হয়। এই অপবাদ দিয়ে তাঁকে কানে ধরে ওঠবস করানো ও মারধর করা হয়। শ্যামল কান্তিও বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে চাপে রাখতেই প্রভাবশালী এক ব্যক্তির নির্দেশে ষড়যন্ত্রমূলক এই ঘুষ গ্রহণের মামলাটি করা হয়েছে।
এখন শ্যামল কান্তি কী করবেন? সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছেন। অভিযোগ করেছেন যে, তাঁকে সপরিবারে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখন রাষ্ট্র কি তাঁর নিরাপত্তা দেবে নাকি এই ‘মালাউনের বাচ্চা’ ন্যায়বিচারের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বার ঘুরবেন? নাকি নিজের আর পরিবার-পরিজনের প্রাণ বাঁচাতে একদিন ঠিকই রাতের আঁধারে সহায়সম্বল ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে পালাবেন? কিন্তু শ্যামল কান্তি কোথায় যাবেন? ‘মোল্লার দৌড় যে মসজিদ পর্যন্ত’, সেই ভারতে? শ্যামল কান্তির কি পাসপোর্ট আছে? তাঁর স্ত্রী-সন্তানের? সেলিম ওসমান সাহেব কি তাঁর পাসপোর্ট, ভিসা আর টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবেন?
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।