বই আলোচনা
ভিন্ন অভিব্যক্তিতে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের নতুন বই ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ’ (২০১৬), তাঁর ভিন্নমতের ভাষ্য হিসেবে এরই মধ্যে পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান অনেক দিন থেকে এ দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন। একই সঙ্গে সেই ভাবনা-চিন্তা সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশের জন্য দিয়েছেন। টিভি টক শোতে তিনি যেমন সমসাময়িক বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে সব সময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তেমনি কলাম লেখায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনে সর্বদা সচেষ্ট। তাঁর মতামত নিজস্ব, তাঁর যুক্তি বিশিষ্ট এবং বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি নির্ভীক।
‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বাংলায় ৫৭টি এবং ইংরেজিতে দুটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় থেকে শুরু করে তিনি এই অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রবন্ধগুলোতে কথা বলেছেন সহজ-সরল ভাষায়। সেখানে যেমন আমাদের জাতীয় উৎসবের কথা আছে, তেমনি আছে একুশে ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১০ জানুয়ারি, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট, ১৭ মে প্রভৃতি উপলক্ষে রচিত নিবন্ধগুলোর বক্তব্য। অর্থাৎ বাঙালির বৈশাখী ঐতিহ্য থেকে যাত্রা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে দেশ থেকে জঙ্গিবাদের অবসান কামনা করেছেন তাঁর লেখনীর মধ্যে। তাঁর মতে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। আর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশকে। আসলে বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের অসংখ্য প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ড. মীজানুর রহমানের রচনায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, তাঁর নিরন্তর সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ডিজিটাল ধারায় পথচলা, উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে তুলে আনা প্রভৃতি বহু বিষয়ে আলোকপাত করেছেন লেখক।
সূচিপত্র পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ড. মীজানুর রহমান পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম দিবস সম্পর্কে যেমন ভেবেছেন এবং লিখেছেন, তেমনি তিনি আরো কিছু বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি এ দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার দর্শন হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ‘আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান’ বক্তব্যকে তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি অংশ স্মরণীয়, “ধর্মীয় জঙ্গিত্ব একটি আদর্শিক সমস্যা। যারা একমুখী একটি দর্শনে বিশ্বাস করে এবং বিপরীতে আমরা কোনো দর্শন খুঁজে পাচ্ছি না। এই র্যাডিকেল দর্শনকে মোকাবিলার জন্য আমাদের আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যেতে হবে—আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’—এই দর্শনকে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের দার্শনিক দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। বাঙালির যে শাশ্বত সংস্কৃতি, সেটা বরাবরই উদার, পরমতসহিষ্ণু ও অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।”
শেখ হাসিনার অবদানের কথা বলতে গিয়ে সেনানিবাসকেন্দ্রিক রাজনীতির অবসানে তাঁর কৃতিত্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন লেখক। লিখেছেন, ‘রাজনীতির বেসামরিকীকরণ শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠ অবদান। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ২০০৯-পরবর্তী সময়ে দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে দেশে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে আইনসিদ্ধভাবে সেনানিবাসের বাইরে নিয়ে আসা। এখানেই আমি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিহীন ডলারভিত্তিক উন্নয়ন টেকসই হবে না বলে মনে করেন। তাঁর মতে, ‘আমাদের অর্থনৈতিক সূচক এমন সক্রিয়, তাতে কেউ না চাইলেও দেশ এগিয়ে যাবে। সমস্যা হলো, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় আমরা যদি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকি, তাহলে একপর্যায়ে দেশ মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে খুব চিন্তা করে কাজ করতে হবে। যাতে উভয়ের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য থাকে। কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের কাম্য হতে পারে না। যদি সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একতালে অগ্রসর হয়, তাহলে আমরা ২০৪১ সালের আগেই জাতির জনকের স্বপ্ন—সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব এবং সেটাই কেবল টেকসই হবে, কেবল মাথাপিছু ডলারের হিসেবে উন্নয়ন টেকসই হবে না।’
অন্যদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের শিক্ষা তাঁর ভাবনায়, বেশি উন্নয়ন কম রাজনীতি। তবে ড. মীজানুর রহমান গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছেন নিরন্তর। এ জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসনির্ভর গণতন্ত্র কাম্য নয়।’
একজন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক হিসেবে, উপাচার্য হিসেবে দেশের শিক্ষা নিয়ে পাঠকরা তাঁর কথা শুনতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ কারণে লেখক সুষম শিক্ষানীতি নিয়ে কলাম লিখেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষকের সম্মান, কারিগরি শিক্ষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি বিনিয়োগের সবচেয়ে জরুরি খাত শিক্ষা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ছাত্ররাজনীতি নিয়েও ভেবেছেন। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে তিনি। কারণ, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ জন্য বাজেটে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে তিনি।
অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদিতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন ড. মীজানুর রহমান। তাঁর মতে, চাপাতি নয়, বিজ্ঞানমনস্কতাই হোক বিজয়ের হাতিয়ার। জঙ্গিবাদ দমনে সামাজিক প্রতিরোধকে নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে তুলে ধরতে গিয়ে এ দেশে মাইক ব্যবহারের বিধিবিধান নিয়েও কথা বলেছেন। তাঁর মতে, জঙ্গিবাদকে জাতীয় দুর্যোগের মতোই মোকাবিলা করতে হবে। তা ছাড়া তরুণদের নিয়েই স্বপ্ন দেখতে হবে। এ জন্য তাদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে অভিভাবকদের। তিনি আলোচ্য গ্রন্থে বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন, লিখেছেন মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করতে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া কয়েকটি প্রবন্ধে ড. মীজানুর রহমান শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের গতিধারা পর্যালোচনা করেছেন নিবিড়ভাবে।
মূলত ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান দেশ, জাতি, সমাজের গভীর ও জটিল বিষয়কে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ভাষা শাণিত, সহজবোধ্য এবং যুক্তিবিন্যাসে দৃষ্টান্ত ব্যবহারে তিনি দক্ষ। তিনি পাঠকসমাজকে সহজেই কাছে টানেন তাঁর ভিন্নমতের যুক্তি দিয়ে। যে ভিন্নমত আমাদের বিষয় বোধ্যগম্যতায় সহায়তা করে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
(বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ঢাকা, প্রচ্ছদ : আক্কাস খান, ২০১৬, মূল্য : ৪০০ টাকা)