নিরাপত্তা পরিষদ
ঠুঁটো জগন্নাথের প্রতি আস্থার বিস্ফোরণ?
বাংলাদেশিরা নানা কারণে বিবিধ বিষয়ে ইদানীং বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠেন। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই পক্ষের লোকের অভাব নেই। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল বিষয়েও মাঠ দখল করে আছেন আশাবাদীরা। বাস্তবতা কতটা সেই আশাবাদের পক্ষে যাবে, সে চিন্তা করতেও অনেককে দেখছি নারাজ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের টিভি আর পত্রপত্রিকা এবং সেগুলোতে কথা বলা বিশেষজ্ঞরা যেভাবে জাতিসংঘ এবং এর নিরাপত্তা পরিষদকে অনেকটা ঈশ্বরের ভূমিকায় বসিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এই বাংলাদেশ কি ভুলে গেছে ১৯৭১-এর কথা? একাত্তরে যখন ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক গণহত্যার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ, তখন এই জাতিসংঘ কী করেছে? এই নিরাপত্তা পরিষদ কী করেছে? গণহত্যা বন্ধ করতে পেরেছে? পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় জাতিসংঘের কি কোনো ভূমিকা ছিল? মোটেই ছিল না। বরং শেষের দিকে যখন দেখতে পেয়েছে পরিস্থিতি অনুকূলে নেই, তখন তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই একটা প্রস্তাব পাস করতে যাচ্ছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর মুখে পণ্ড হয়ে যায়। তাহলে এই জাতিসংঘ আর এর নিরাপত্তা পরিষদকে মানবিক ঈশ্বরের ভূমিকায় দেখতে আপনাদের কে বলেছে?
আরো উদাহরণ আছে। পৃথিবীর যেখানে যেখানে এর আগে গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় হয়েছে, কোথাও জাতিসংঘ বা এর নিরাপত্তা পরিষদ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। যদিও নিরাপত্তা পরিষদকে বলা হয় বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংগঠন। আদতে এটি ঠুঁটো জগন্নাথ। রুয়ান্ডার গণহত্যা, সভ্য ইউরোপের একেবারে মধ্যখানে বলকান অঞ্চলে বসনিয়া ও কসভোর গণহত্যা, শ্রীলঙ্কায় তামিল গণহত্যাসহ পৃথিবীর কোথাও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি জাতিসংঘ। বরং অভিযোগ আছে উল্টোটা। যেমন বসনিয়া ও কসভোয় গণহত্যার সময় জাতিসংঘ বাহিনীকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যাতে নীরবে বাধাহীন হত্যার উৎসব চলতে পারে। এমনকি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ অঞ্চলে ডেকে নেওয়ার কথা বলে সাত হাজার মানুষকে একত্রে হত্যা করা হয়েছিল।
এতসব জ্বলন্ত উদাহরণ সামনে থাকার পরও বাংলাদেশিরা একেবারে ঢোল বাজিয়ে আশার প্রচারণা চালিয়েছেন। তারা জাতিসংঘকে মনে হয় ঈশ্বর-টিশ্বর কিছু একটা ভেবে বসে আছেন। অনেকে না বুঝেই বলতে শুরু করেছিলেন বৃহস্পতিবারই নিরাপত্তা পরিষদ বুঝি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলবেন। কেউ কেউ বলেছেন অস্ত্র ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
প্রথম কথা হলো, বৃহস্পতিবারের বৈঠকটি জাতিসংঘের ইতিহাসেই একটি ব্যতিক্রমী বৈঠক। এটি ছিল একটি উন্মুক্ত আলোচনার আসর। সাধারণত কোনো বিষয়ে যে প্রস্তাব পাস করা হয় বা কোনো দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়– এ বৈঠকটি সে ধরনের বৈঠকই ছিল না। এখানে সুপারিশ আসার পরে হয়তো আরেকটি বৈঠকের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব পাস করা হতো। সুতরাং বৈঠকের ধরন না বুঝেই অনেকে আশাবাদী হয়েছেন।
দ্বিতীয় কথা হলো, অতীতে এমন কোনো রেকর্ড নেই যে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদেই সমাধান হওয়ার আশা করা যায়। মনে রাখতে হবে, এই সংকটে নিরাপত্তা পরিষদের দুই প্রভাবশালী সদস্য রাশিয়া ও চীন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে গণহত্যার সংগঠক মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এবং তা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরুর আগেই। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিও অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে তাঁর দেশের সেনাবাহিনীর অভিযান সম্পর্কে তাঁর এনএলডি সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তারা ভালো ভালো কথা বললেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ভাষণে কিংবা অন্য কোথাও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি কথাও বলেননি। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিতে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের পরও তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন।
রাশিয়া আর চীনের পরিষ্কার অবস্থান জানার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নির্লিপ্ততা নিরাপত্তা পরিষদকে শুরুতেই পাঁকে বেঁধে ফেলেছে বলে আমি মনে করি। সুতরাং বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনা থেকে শেষ পর্যন্ত যে ‘পর্বতের মুষিক প্রসবে’র মতো কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে তাতে আশাবাদীরা আশ্চর্য হতে পারেন, আমি এতে আশ্চর্যের কিছু দেখি না।
আমি বরং আশ্চর্য হই, কী করে বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি কর্তাব্যক্তি থেকে নিয়ে পেশাদার কূটনীতিকরা পর্যন্ত বৃহস্পতিবারের ওই বৈঠকটিতে অনেক কিছু হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলেন। পেশাদার কূটনীতিকরা কি জাতিসংঘের আচরণ কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা জানেন না? ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি সত্যিকার অর্থে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কি নিতে পেরেছে? যেখানে বৃহৎ শক্তির স্বার্থ আছে, সেখানেই কেবল এটি হম্বিতম্বি করেছে। গরিবের পক্ষে, নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কোনো ভূমিকা ৭০ বছরে কখনোই নিতে দেখা যায়নি দিনে দিনে অথর্ব পরিচিতি পেতে যাওয়া এই সংস্থাকে। অতএব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কেটেকুটে সাফ করে ফেলা হলেও বৃহৎ শক্তিদের স্বার্থে কোনো আঘাত না এলে এবং বিপরীতে কোনো না কোনোভাবে যদি তা তাদের স্বার্থের অনুকূলে চলে যায়, তাহলে জাতিসংঘের কোনো ক্ষমতা নেই এখানে কিছু করার।
তাহলে কী হবে? কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ? গত সপ্তাহে এনটিভি অনলাইনেই ‘রোহিঙ্গা সংকটের প্রলম্বিত ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে একটা লেখায় বলেছিলাম, বাংলাদেশকে অবশ্যই অবশ্যই কোনো না কোনো বৃহৎ শক্তির দ্বারস্থ হতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা যত দ্রুত সম্ভব সেই মুখি করতে হবে। পররাষ্ট্রনীতির সামান্য একটু এদিক সেদিক করে হলেও আমাদের একটি শক্তিধর বন্ধুরাষ্ট্র দরকার। ‘সকলের সাথে বন্ধুতা কারো সাথেই শত্রুতা নয়’– এই তত্ত্ব বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ‘অ্যালাই’ দরকার। নন-অ্যালাইনমেন্ট বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের যুগ যে শেষ তা তো এর স্থবির কার্যক্রম দেখেই বুঝে নেওয়া যায়। আপনার নিজের দিক থেকে কারো সঙ্গে শত্রুতা না থাকতে পারে, কিন্তু যদি কেউ আপনার সঙ্গে শত্রুতা শুরু করে তাহলে কি আপনি চুপ থাকতে পারবেন? তাহলে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কী করে টিকবে? মিয়ানমার তার দেশের ১০ লাখ মানুষকে এ দেশে ঠেলে দিয়ে পরোক্ষভাবে তো শত্রুতাই ঘোষণা করেছে। তাদের হেলিকপ্টার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। সীমান্ত এরই মধ্যে ভারসাম্যহীন হয়েছে। আর কতদিন বন্ধুত্বের মুখোশ পরে থাকা যাবে?
মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্র যদি এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়াকে বগলদাবা করতে পারে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির নীতিনির্ধারকরা কী করেন? বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এই অঞ্চলটিতে সব বিশ্বশক্তিরই যে শকুনি চোখ নিবদ্ধ আছে তা কি আমরা জানি না? ভূ-রাজনীতির এই খেলা বুঝতে আমাদের আর কতদিন লাগবে। মিয়ানমার সরকারের গতিবিধিই বা আমরা কতটা ফলো করছি। নিজেদের একনিষ্ঠ মুরুব্বি চীনকে না জানিয়ে বা তাদের সবুজসংকেত না পেয়ে রোহিঙ্গাদের স্বমূলে উৎপাটন করার মানসিক শক্তি মিয়ানমারের মোটেই নেই। রাখাইনে ইকোনমিক জোন করা এবং এর পেছনে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যেকের এখানে সমর্থন আছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এবং নিরাপত্তা পরিষদে- দুই জায়গাতেই মিয়ানমারের প্রতিনিধির বক্তব্য এবং সে সময়ে তাঁর চেহারার ভাব আমি খুব ভালোভাবে লক্ষ করেছি। তাঁর বক্তব্যে যেমন সু চির ভাষণের বাইরে কিছু নেই, তেমনি জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের ঝাঁঝালো সমালোচনায়ও তাঁর চেহারায় উদ্বেগের কোনো রেখাপাত হয়নি। হবেই বা কেন? আগে থেকেই তো জানা আছে, এখানে কী হবে।
একদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও ইউএনএইচসিআর প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা সংকটকে শতাব্দীর সবচেয়ে জটিল এবং চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে মিয়ানমার এখনো সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা কি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দেখছে না? অবশ্যই দেখছে। এবং জেনেশুনেই তারা কিছু করছে না, করবেও না। যেহেতু জাতিসংঘ বলি আর নিরাপত্তা পরিষদ বলি, সবই একটা ঠুঁটো জগন্নাথ। তাদের নামের বাহার আছে, কাজের শক্তি নেই। পরিবারের বড় ভাইয়েরা কিছু করতে বললেই কেবল তারা নড়েচড়ে বসে। এর বাইরে তাদের কিছুই করার নেই। সুতরাং আশাবাদীরা আপাতত বরং অন্য কোথাও চোখ রাখুন। নিউইয়র্কে (জাতিসংঘ সদর দপ্তর) আপনাদের জন্য কিছু নেই।
আগের লেখায় বলেছিলাম, এবারের রোহিঙ্গা সংকট প্রলম্বিত হবে এবং সামরিক বা রাজনৈতিক শক্ত কোনো পদক্ষেপ ছাড়া মিয়ানমার একটি রোহিঙ্গা পরিবারকেও ফেরত নিতে রাজি হবে না। কারণ, তারা এবার অভিযান শুরুই করেছে রাখাইনের জমি খালি করতে, কেবল মানুষ নয়। যে জমিতে তারা ইকোনমিক জোন গড়ে তুলবে। যেখানে চীন-রাশিয়া আর ভারতের বিনিয়োগ আছে, আরো হবে। আলোচনার নামে যে কূটনৈতিক তৎপরতা তারা শুরু করেছে তাও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনারই অংশ। আলোচনা মানেই সময়ক্ষেপণ। আলোচনা মানেই ১০ লাখের মধ্যে এক লাখ নিয়ে লোক দেখানো টাইপের কিছু করা।
এর বাইরে যদি কিছু হয়, তা আমার কাছে অলৌকিকই মনে হবে। সুতরাং অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশায় বসে না থেকে রোহিঙ্গাদের কীভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনা যায়, সেদিকেই আপাতত জোর দেওয়া দরকার। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের টাকা যেন অন্তত বাইরে থেকে পাওয়া যায় সে ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রোহিঙ্গারা এ দেশে আসতে শুরু করেছে ৪০ বছর হয়ে গেল প্রায়। বাংলাদেশের মাটি থেকে শেষ রোহিঙ্গা পরিবারটি ফেরত নিতে নিতে মিয়ানমার গোটা একটা শতাব্দীও পার করে দিতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি