অভিমত
খাজনার চেয়ে বাজনা কেন বেশি হবে?
‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’-এ প্রবাদ বাক্যটা কোন বিষয়টিকে সামনে রেখে সৃষ্টি হয়েছিল? তা জানি না। তবে মনে হয় বিষয়টি এ রকম যে, কোনো কিছুর খাজনা যদি হয় ৬০ টাকা, সেটা দিতে গিয়ে যদি ১৫০ টাকার গাড়ি ভাড়া প্রয়োজন পড়ে তখন মানুষ বলে, খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি গেল।
যেমন ঢাকা শহরের অনেক এলাকার জমির বাৎসরিক খাজনা এখনো কাঠা অনুযায়ী ৯০ বা ৯৫ টাকা। বাংলা বছর অনুযায়ী এ খাজনা দিতে হয়। কিন্তু যে এলাকার খাজনা ৯০ টাকা সে এলাকার জমির খাজনার গ্রহণের ভূমি অফিস বা তহশিল অফিসের অবস্থান এমন এক জায়গায় সেখানে যেতে আসতে যানবাহনে খরচ পড়ে এক থেকে দেড়শ টাকা কমসে কম। তখন নিশ্চয়ই একজন খাজনাদাতা মনে মনে বলেন, ইশ ৯০ টাকা খাজনা দিতে গিয়ে আমার দেড়শ টাকা সিএনজিচালিত বেবিটেক্সিতে খরচ হয়ে গেল।
খাজনার এ বিষয়টি মাথায় এলো ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের ওভারটাইম সংক্রান্ত একটি খবর পড়ে।
ঢাকার একটি ওয়াসার পাম্প অপারেটরের বেতন ১৭ হাজার ৯৬০ টাকা। গত আগস্ট মাসে তিনি ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ওভারটাইম বিল তুলেছেন ৬৯ হাজার ৩৫২ টাকা। বিষয়টি ভাবা যায়!
এটা শুধু ওই পাম্প অপারেটর একা নন, ঢাকা ওয়াসার সাড়ে তিন হাজার কর্মীর প্রায় সবাই এ রকম অস্বাভাবিক ওভারটাইম তুলেছেন প্রতি মাসে- এ কথাটিও ওই খবরে জানা গেছে।
উক্ত অপারেটর গত ডিসেম্বর মাসে মোট ৩৩৫ ঘণ্টা ওভারটাইম করেছেন। প্রতিদিন তিনি ১১ ঘন্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন,অর্থাৎ প্রতিদিন ১৯ ঘণ্টা কাজ করেছেন।
সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো ঢাকা ওয়াসা আর্থিক সংকটে থাকলেও কর্মচারীদের ওভারটাইম দিতে কোনো সমস্যা হয়নি।
প্রশ্ন আসতেই পারে কীভাবে সম্ভব এত টাকা ওভারটাইম দেওয়া? না দিলে লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই কর্মচারীদের ওভারটাইম নিয়ে কর্মকর্তারা বেশি কিছু বলার সাহস দেখাতে পারেন না। ওই খবরেই জানা গেল গত জুন মাসে ওভারটাইমের দাবিতে ওয়াসার প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে কর্মচারী ইউনিয়নের লোকেরা।
কর্মচারী ইউনিয়নের এক নেতা বলেছেন,লোকবল কম থাকায় কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজ করে ওভারটাইম নিয়ে থাকে। এটা দোষের কিছু না।
কত সুন্দর কথা! আমাদের দেশের প্রত্যেকটা জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দশা এ রকম। বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, পৌরসভাসহ সবখানে রয়েছে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের দৌড়াত্ম্য।
তাদের এত ক্ষমতার উৎস কোথায়? এর উৎস হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে রয়েছে তাদের সরাসরি যোগাযোগ। তারা জানে একজন কর্মকর্তা আজ আছে কাল অন্য জায়গায় চলে যাবে। কিন্তু কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা তার নেতৃত্বের কারণে থেকে যাবে বছরের পর বছর একই জায়গায়। তার কোনো পদোন্নতির দরকার পড়ে না। কাজ না করে দিনের পর দিন বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সব পেয়ে যাচ্ছে। তা হলে তার কি দরকার পদোন্নতি? বরং অনেকের বদলি আর পদোন্নতির তদবির করে লাখ লাখ টাকা কামানো সম্ভব। সরকারি পর্যায়ের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের কারণে তাকে অনেক বড় বড় কর্মকর্তাও হিসেবে রাখে। বলা যায় সম্মান দেয়। আর এই সুযোগটা গ্রহণের ফলে দিনের পর দিন জনগণের এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি ফুলেফেঁপে উঠছে একেকজন সিবিএর নেতা। সরকারের নেক নজরে থাকার কারণে একেকটি প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লোকসান গুনলেও শ্রমিকদের অবৈধ ওভারটাইম থেকে শুরু করে নানাভাবে দুর্নীতির ব্যাপারে থেকে যায় চুপ। কর্মকর্তারা ভয়ে থাকে তটস্থ।
সরকারের সদিচ্ছার অভাবে দিনের পর দিন এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ছে। সেবা তো দূরের কথা,তাদের কোনো সমস্যা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে গেলে আগেই নেতাদের নিয়োজিত দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়। যেকোনো কাজে তাদের ছাড়া হয় না।
বাড়িতে নতুন পানির মিটার নেবেন? বিদ্যুতের নতুন মিটার নেবেন? গ্যাসের নতুন কানেকশন বা বাড়তি সংযোগ নেবেন? তাদের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাতে হবে। এতে নির্ধারিত ফিয়ের দ্বিগুণ তিনগুণ টাকা গুনতে হবে। অন্যথায় মাসের পর মাস অফিসে গিয়ে ঘুরতে হবে। আপনার আবেদনপত্রের ফাইল আর এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যাবে না।
আমাদের এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সরকারের রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে যত দিন বের হতে না পারবে তত দিন অন্যায় আর দুর্নীতি বন্ধ হবে না। বছরের পর বছর আর্থিক সংকট লেগেই থাকবে। আর কর্মচারীরা নির্দিষ্ট কাজের সময় কাজে না থেকে ওভারটাইমের টাকা গুণবে।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।