শিক্ষা
হাতেখড়ির একাল-সেকাল
হাতেখড়ি অনুষ্ঠানটি উঠে যাচ্ছে। কেননা, শিশুরা এখন আর স্লেটে লেখে না। বয়স দুই বছর হতেই তারা মোবাইল ফোন, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ চিনে যায়। আনন্দ আর বিদ্যা অর্জন একই উৎসে। ফলে ঘটা করে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না, বিশেষ করে শহুরে শিশুদের তো নয়ই।
তবে প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, দুই নম্বরির হাতেখড়িও বাড়ছে। শিশু বয়সেই তারা শিখে নিচ্ছে, কীভাবে নকল করতে হয়, কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস করতে হয় এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কী করে পরীক্ষা দিতে হয়!
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনাম ছিল : সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছেন অভিভাবকরা! যেখানে বলা হয়েছে, পিইসির গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বাইরে চলে আসার পর অভিভাবকরা কেন্দ্রের আশপাশে দলে দলে ভাগ হয়ে উত্তর লিখছেন। কেন্দ্রের ভেতরে শিশুরা এবং বাইরে তাদের অভিভাবকরা পরীক্ষা দিচ্ছেন। প্রশ্নপত্র কীভাবে বাইরে এলো—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অভিভাবকরা বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতর থেকে প্রশ্নটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তুলে স্থানীয় কোচিং সেন্টারের পরিচালকরা সরবরাহ করেন। আর সেই প্রশ্ন দেখে সাদা কাগজে উত্তর লেখার পর দায়িত্বরত শিক্ষকদের ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীদের কাছ পৌঁছে দেওয়া হয়।
প্রাথমিক স্কুলের এই কোমলমতি শিশুরা দেখছে, তাদের বাবা-মায়েরা কী নিপুণ কৌশলে এই বয়সের তাদের দুই নম্বরি শেখাচ্ছেন! এই শিশু বড় হয়ে মানুষের পকেট কাটবে, ঘুষ খাবে, রাষ্ট্রের পয়সা নিজের মনে করে তা লুটপাট করে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়বে এবং ‘এই দেশটার কিসসু হবে না’ বলে খেদ ঝেড়ে একদিন পরিবারসমেত উড়াল দেবে––তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে? এই শিশুদের কাছ থেকে জাতি কী আশা করবে?
তবে দোষ এই শিশুদের নয়। যে অভিভাবকরা কেন্দ্রের বাইরে বসে তাদের সন্তানদের অঙ্ক করে দিচ্ছেন, দোষ তাঁদের। তাঁরা অপরাধী। সন্তানকে অপরাধী করে তুলছেন তাঁরা। শেখাচ্ছেন, এ রকম নকল করে পাস করায় দোষের কিছু নেই; বরং যে করেই হোক জিপিএ ফাইভ পেতে হবে।
এই শিশুরাই ভবিষ্যতের অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় হয়তো জিপিএ ফাইভ পাবে এবং শেষ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় গিয়ে ইংরেজিতে ২০ পাবে এবং তখন আমরা আহা-উহু করব এই বলে যে, ‘জিপিএ ফাইভ এসে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে।’ অথচ দেশের বারোটা যে এই কথিত অভিভাবকরাই বাজিয়েছেন এবং বাজাচ্ছেন, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
জাতীয় সংসদে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ খাদ্যে ভেজাল, বিশেষ করে ফরমালিনের মতো বিষ মেশানোর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার দাবি তুলেছেন। আমার মনে হয়, যে অভিভাবকরা সন্তানের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অপেক্ষায় থাকেন কিংবা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের জবাব লিখে দেন অথবা এ রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন, তাঁদের শাস্তির জন্যও মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা উচিত। কারণ, তাঁরা স্বউদ্যোগে একটি দুই নম্বর প্রজন্ম গড়ে তুলছেন।
পরীক্ষার উদ্দেশ্য, এখন যে করেই হোক জিপিএ ফাইভ পেতে হবে। কী শিখলাম, কী জানলাম, নিজের বোধ কতটুকু তৈরি হলো, সন্তানকে কতটা মানুষ করতে পারলাম, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ ওই কথিত বাবা-মায়ের নেই। কথিত বলছি এ কারণে যে, যাঁরা শিশুসন্তানের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অপেক্ষায় থাকেন, যাঁরা নিষ্পাপ শিশুদের দুই নম্বরির হাতেখড়ি দেন, তাঁদের আসলেই বাবা-মা বলা যাবে কি না, তা নিয়েই বরং ভাবা দরকার।
সম্প্রতি আরেকটা খবরের দিকে আমরা নজর দিতে পারি। তা হলো—স্কুল পর্যায়ে কমিটি করবে ছাত্রলীগ। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে দলের নেতারা বলেছেন, স্কুলে ছাত্রসংগঠনের কমিটি নতুন কিছু নয়। কেননা, স্কুল পর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ড আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্কুল পর্যায়ে ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে আমরা আসলে কী অর্জন করতে চাই?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত হওয়া উচিত। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা নিজেদের বুঝতে শেখে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তৈরি হয়। তখন তারা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যদি রাজনীতিতে যুক্ত হতে চায়, হবে। তবে ছাত্ররাজনীতির নামে এখন কী হচ্ছে, নেতৃত্ব শেখানোর নামে তারা আসলে কী শিখছে, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্যদিকে, যৌবনে পদার্পণের আগেই যদি স্কুল পর্যায়ে শিশু রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হয়, তাহলে সেখানে দেশ গড়া বা সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার বিপরীতে বরং তাদের মধ্যে ভোগবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠার শঙ্কা থাকে। এ বয়সে ক্ষমতার মোহ তাদের পেয়ে বসলে পড়ালেখার বারোটা বাজবে। তারা বরং প্রশ্ন ফাঁসের মতো কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়ে যেতে পারে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে পারে একটা অসৎ প্রজন্ম।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।