ক্রিকেট
মিডিয়ার দিকে বাউন্সার ছুড়ে লাভ কী
প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ খালেদ মাহমুদ। তাঁর রাগ আর ক্ষোভের বিস্ফোরণ দলের হারে নয়। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে বাজেভাবে হেরেছে বাংলাদেশ দল। ঢাকা টেস্টে আড়াই দিনে শেষ বাংলাদেশের লড়াই। টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচেও দলের সেই বিপন্ন অবস্থা। করুণ চেহারা! কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৎ সাহস দেখাতে পারলেন না বাংলাদেশ দলে আপাতত যার পরিচয় টেকনিক্যাল ডিরেক্টর সেই খালেদ মাহমুদ! বরং উল্টো তিনি এসবের জন্য প্রশ্ন তুললেন সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। শুধু প্রশ্ন তুলে বসে থাকেননি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো এখানেও তিনি প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরটাও জানিয়ে দিলেন, ‘নোংরা বলতে গেলে মিডিয়াতে যেভাবে লেখা হয়। মিডিয়ারও একটা ভূমিকা আছে যে আমরা ফিশি হয়ে যাচ্ছি। এখন মিডিয়া ফিশি। মিডিয়ার কারণে আমাদের ক্রিকেট আটকে আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। মিডিয়াতে ভালো-খারাপ সবই হবে। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটের জন্য খুব খারাপ।’ সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার আসলে নোংরা লাগছে। এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমি আর আগ্রহী নই।’
খালেদ মাহমুদের কথাগুলো শুনে এবং পড়ে অবাক হওয়ার কিছু দেখছি না। বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। এটা নিজের অজ্ঞতা সেটা মানতেও দ্বিধা নেই।
নিজের সেই অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই বলেই জানি। তারপরও নিজে মিডিয়ার অংশ। খালেদ মাহমুদের দু-একটা কথার ইতিবাচক অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছি। শেষ দিকে তিনি একটা কথা বলেছেন, ‘এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমি আর আগ্রহী নই।’ পরোক্ষভাবে এ রকম অকপট স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের কজন মানুষ দিতে পারেন। কজনে বলতে পারেন! স্বার্থ যেখানে নেই, সেখানে খালেদ মাহমুদ কেন? কে-ই বা কাজ করছেন এই সমাজে! ক্রিকেটে তো আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপের জিনিস নয়। স্বার্থ যেখানে নেই, সেখানে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন এটা স্বাভাবিক। কারণ, স্বার্থ, স্বার্থ-সংঘাত এই সব শব্দ বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রথম খালেদ মাহমুদের মুখ থেকে স্টেটমেন্ট হিসেবে বেরিয়েছে। আর তার প্রায় অর্ধযুগ পরে এসে তিনি নিশ্চয় সেগুলোকে সংবাদমাধ্যমে ‘মিসকোট’ বলে ‘ডাক’ করার চেষ্টা করবেন না।
প্রথম বিপিএলে চিটাগং কিংসের কোচের দায়িত্ব নিতে গিয়ে খালেদ মাহমুদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, বোর্ডের সদস্যপদে থেকে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের কোচিং করানো আসলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় স্বার্থ-সংঘাত। স্বার্থ থাকলে স্বার্থ-সংঘাত হতে পারে, সেই উপলব্ধি খালেদ মাহমুদের নিশ্চয়ই ছিল। বিশ্বাস করতে চাই, এখনো আছে। আর সে কারণে তিনি বলেছেন, এখানে তাঁর কোনো স্বার্থ নেই। তাই আগ্রহও নেই। পেশাদার কথাবার্তা। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে তিনি যা করেছেন, সেটা নিঃস্বার্থভাবে করেছেন। এখানে তাঁর রুটি-রুজির কোনো বিষয় নেই। অর্থ-কড়ির কোনো প্রশ্ন নেই! তাঁর রুটি-রুজির জায়গা কোচিং। সে কারণে কিন্তু তিনি বিসিবি নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করে বিরল নজির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই লোকটা যখন মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে বলছেন, ‘...এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমার কোনো আগ্রহ নেই।’ তাঁর কথাকেই বিশ্বাস করা উচিত।
কিন্তু বিশ্বাস করবেন কীভাবে? ক্রিকেট। ক্রিকেট মাঠ। এটা খুব ছোট্ট একটা জায়গা। সেখান থেকে একজন খালেদ মাহমুদ যদি মিডিয়ার দিকে কিছু প্রশ্নবাণ ছোড়েন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ক্ষত-বিক্ষত হওয়ারও কিছু নেই। হৃদয়ে রক্তক্ষরণেও কিছু নেই। কারণ গোটা পৃথিবীর চেহারাই এক। প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস যাঁদের নেই, তাঁরাই সংবাদমাধ্যমের দিকে পাল্টা শব্দ হামলা করেন। সেটা মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে দাঁড়িয়ে হোক কিংবা ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে হোক!
সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেওয়া ভদ্রলোকের নাম খালেদ মাহমুদ সুজন হোক কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্প-ই হোক। আসলে তাঁদের সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা, প্রশ্ন, কোনো কিছুকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
সংবাদমাধ্যমের কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট আটকে গেছে খালেদ মাহমুদের এই গবেষণার জন্য বিসিবির এখন করণীয় হয়ে দাঁড়াতে পারে ক্রিকেট থেকে মিডিয়াকে আরো দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বটাও তাঁকেই দেওয়া উচিত। তাতে না হয় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য আরো একটু জায়গা পাবেন খালেদ মাহমুদ। পদ না হয় আর একটা বাড়ল তাতে কী!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিডিয়ার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশাসনও গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নজরদারি রাখছে সারাক্ষণ। মালদ্বীপের মতো ছোট দ্বীপরাষ্ট্রেও মিডিয়ার কণ্ঠরোধের চেষ্টা হচ্ছে। সাংবাদিক গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ রকম বিশাল এক পৃথিবীর কথা নিশ্চয়ই জানেন খালেদ মাহমুদ। সেই পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে মাহমুদ না হয় একটু ক্ষোভ উগড়ে দেবেন সংবাদমাধ্যমের ওপর সেটা আর এমন কী!
হয়তো কিছু না। আবার অনেক বড় কিছু। কারণ, তাঁর কথায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিপন্নতা ফুটে উঠল নাকি সংবাদমাধ্যম বিপন্ন হয়ে পড়ল, সেটা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। ক্রিকেট এ দেশের মানুষের কাছে শুধু একটা খেলা নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু। সে কারণে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তাঁর দপ্তরে ফাইলের স্তূপ ফেলে রেখে মাঠে ছুটে যান ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো জয় উদযাপনে। মাঠে যেতে না পারলে ক্রিকেটারদের ডেকে পাঠান তাঁর নিজের সরকারি বাসভবনে। সেই ক্রিকেটের বহু অঙ্গে বহুভাবে জাড়িয়ে থাকা একজন লোক যদি বলেন, আমাদের ক্রিকেট মিডিয়ার কারণে আটকে আছে কি না! সেটা সত্যিই ভেবে দেখা উচিত।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিজস্ট