ক্রিকেট
‘লাক’ হতে পারে ওয়ালশের এক্স ফ্যাক্টর
৫১৯ টেস্ট উইকেট। ২২৭ ওয়ানডে উইকেট। সব মিলিয়ে ৭৪৬ আন্তর্জাতিক উইকেট। ১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ৪০ হাজারের বেশি বৈধ ডেলিভারি দিয়েছেন। বল হাতে কত হাজার মাইল দৌড়াতে হয়েছে তাঁকে? তার সঠিক অঙ্কটা জানা না গেলেও কাছাকাছি একটা সংখ্যা হয়তো ভিডিও ফুটেজ দেখে বের করা যেতে পারে। কিন্তু মেপে বের করা যাবে না তাঁর হৃদয়ের উদারতা। ক্রিকেটীয় শিষ্টাচার। মাঠে ভয়ংকর ফাস্ট বোলার হয়েও কীভাবে মাঠের বাইরে এতটা বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, শান্ত এবং নিরাবেগী থাকতে পারেন!
পারেন, কারণ আধুনিক জমানায় ক্রিকেট খেলেও তিনি ঠিক প্লেয়ার ছিলেন না। ছিলেন ক্রিকেটার। প্লেয়ার আর ক্রিকেটারের মাঝে একটা বিভাজন রেখা তো রয়েই গেছে। ক্রিকেট নামক খেলাটায় প্লেয়ার কিংবা ক্রিকেটার কেউ-ই হারতে চান না। তবে ক্রিকেটাররা কখনো যেনতেনভাবে জিততে চান না। ক্রিকেট খেলাটার একটা গুডউইল আছে। সেটাকে বিসর্জন দিতে চাইবেন না তাঁরা। ক্রিকেটের স্পিরিটের বিপক্ষে তাঁরা। ক্রিকেটাররাও জানেন, দলের জেতা দরকার। তবে ক্রিকেটের স্পিরিটকে বিসর্জন দিয়ে নয়। কোর্টনি ওয়ালশ হচ্ছেন সেই প্রজাতির ক্রিকেটার। যে কারণে ’৮৭-এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বল করার সময় নন-স্ট্রাইকিং এন্ডের ব্যাটসম্যান সেলিম জাফর বল ডেলিভারি দেওয়ার আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আইনের মধ্যে থেকে বোলার ওয়ালশ তাঁকে রানআউট করতে পারতেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজও পৌঁছে যেত সেমিফাইনালে। কিন্তু ওয়ালশ তা করেননি। তিনি বরং উল্টো সেলিম জাফরকে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আর তাঁর দল টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। ক্রিকেটে যে এখনো দু-একজন ভদ্রলোক আছেন, তার উদাহরণ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ওই ফুটেজ এক প্রামাণ্যচিত্র।
ক্রিকেট থেকে তাঁর অবসরোত্তর জীবনে একাধিকবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। গলায় মোটা একটা সোনার চেইনে ৫১৯ লেখা ক্রিকেট বল ঝোলানো যার, সেই ভদ্রলোক এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারলেও তা নিয়ে তার কোনো দুঃখ-হতাশা-অনুতাপ-অনুশোচনা নেই। তাঁর ব্যাখ্যাটাও খুব পরিষ্কার। ‘ক্রিকেট হয়তো ছোট্ট একটা খেলা। কিন্তু তারও বড় একটা ট্র্যাডিশন আছে। সেটা বজায় রাখা দরকার। আর আমি যেভাবে বেড়ে উঠেছি তাতে মানুষকে ঠকাতে শেখানো হয়নি।’
সেই লোকটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে আছেন এক বছর আট মাসের মতো। এত দিন তাঁর পরিচয় ছিল দলের বোলিং কোচ। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কী শেখালেন ওয়ালশ! কোথায় ভালো ফাস্ট বোলার পেল বাংলাদেশ! যাঁরা পেস বোলার হিসেবে খেলছেন, তাঁদেরও তেমন উন্নতি কোথায়? কত কিছু! কিন্তু ওয়ালশের মুখ থেকে কোনো জবাব শুনেছেন কেউ? না। কারণ, ক্রিকেট বোধ হয় তাঁকে আরো একটা জিনিস শিখিয়েছে। লুজ বল করো না, যা বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দেবে। তাই খুব লুজ টকও তিনি করেন না। কিন্তু এবার সেই লোকটার নতুন পরিচয়, বাংলাদেশ দলের অন্তর্বর্তীকালীন হেড কোচ। এখন তাঁকে কথা বলতেই হবে। কিন্ত তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে ক্রিকেটীয় দর্শনের খুব একটা তফাৎ হবে বল তো মনে হয় না।
ওয়ালশের কোচিং দর্শন কী, সেটা অবশ্য খুব ভালোভাবে জানা হয়নি। তবে তাঁর ক্রিকেটীয় দর্শন থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। পেস বোলার হিসেবে টেস্টে যার ৫১৯ উইকেট, তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। ১৭ বছরের ক্যারিয়ার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব করেছেন। সেই লোকটার মুখেও শুনেছি ‘লাক’ শব্দটা। ভাগ্যে তিনি খানিকটা বিশ্বাস করেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্তর্বর্তীকালীন হেড কোচ হলেন যখন ওয়ালশ, সেই সময় এ দেশের ক্রিকেটেরও একটা অন্তর্বর্তী সময় চলছে। সাউথ আফ্রিকার মাটিতে সব খোয়ানোর পর নিজেদের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছেও সেই সব খোয়ানোর পালা। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ওয়ালশের কোচিং জাদুতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোন জাদুকরি যুগের সূচনা হবে, সেটা আশা করা একটু বাড়াবাড়ি। একটু না। যথেষ্ট বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু এ দেশের আবেগী মানুষের ক্রিকেট নিয়ে পাহাড় সমান প্রত্যাশা! তারা বুঝতে চান না কী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। তারা চান বাংলাদেশ মাঠে নামবে আর ম্যাচ জিতবে! ওয়ালশও ম্যাচ জিততে চাইবেন। ওয়ালশ কেন, কেউ-ই ম্যাচ হারতে মাঠে নামেন না।
‘লাক’ ছাড়াও ম্যাচ জিততে আরো কিছু জিনিস লাগে। কোর্টনি ওয়ালশের কথায় তাঁর লংকা অভিযানে আরো দুটো শব্দ খুব জোরালোভাবে উচ্চারিত। কোচ শব্দটা তার কাছে পিতৃসুলভ একটা অনুভূতি। কোচ হচ্ছেন দলের ফাদার ফিগার। সেই ভূমিকায় যেতে চান তিনি। আর দলের অধিনায়ককে হয়ে উঠতে হবে ‘বিগ ব্রাদার’। কোচ-অধিনায়ক মিলে ক্রিকেটারদের নিয়ে একটা পরিবর্তনের সূচনা করতে চান তিনি।
ভাগ্যে বিশ্বাসী ওয়ালশকে আপাতত খানিকটা দুর্ভাগা-ই বলতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে তিনি পাচ্ছেন না তাঁর নিয়মিত অধিনায়ককে। অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘বিগ ব্রাদার’ হয়ে ওঠা মাশরাফি বছর খানেক আগে কলম্বোতেই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরে চলে গেছেন। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব পাওয়া সাকিবকেও দল থেকে কেড়ে নিয়েছে ইনজুরি। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহকে নিয়েই তাঁর লঙ্কা অভিযান। আরব সাগরের পাড়ে তিনি অবশ্য ‘মাছের চোখ’ করেছেন বাংলাদেশ দলের উজ্জীবিত পারফরম্যান্সকে।
অন্তর্বর্তী সময়ে বাংলাদেশ দলের হেড কোচের দায়িত্ব পাওয়া মানে ওয়ালশ এখন নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে ক্রিজের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতেই দেখছেন, ‘লাক-বিগ ব্রাদার-ফাদার ফিগার’ এই তিন স্টাম্পের ওপর দুখানা বেল, যার নাম অন্তর্বর্তীকালীন কোচ। বোলার ওয়ালশের রেকর্ড ঈষর্ণীয়। কিন্তু ব্যাটসম্যান ওয়ালশের যা রেকর্ড, তার আশপাশ দিয়েও কেউ হাঁটতে চাইবেন না! শ্রীলংকায় সেই ওয়ালশ কীভাবে স্টাম্প আগলে রাখেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এই আগলে থাকায় ‘লাক’ হতে পারে ওয়ালশের এক্স ফ্যাক্টর।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।