অভিমত
স্যার বলেছিলেন ‘ওকে মেরো না’
জঙ্গি বা উগ্রবাদ নিয়ে ক্লিশে ও সরল সমীকরণে একটা বড় আঘাত দিয়েছিল হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি। মাদ্রাসায় পড়ুয়া গরিব ঘরের সন্তানরাই উগ্রবাদ বা আরো চূড়ান্ত আকারে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে বলে যে মত বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল বা চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো, সেই ধারণা মিথ্য প্রমাণিত হয় যখন দেখা গেল যে, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গিদের অনেকেই কোনোদিন মাদ্রাসায় তো পড়েইনি, বরং তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের এবং কথিত অভিজাত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয়, উগ্রবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে বা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বেহেশতে যাওয়ার পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে ঘর থেকে বেরিয়ে দিনের পর দিন নিখোঁজ––এ রকম অনেক তরুণেরই জন্ম উচ্চবিত্ত পিতার ঘরে, যারা হয়তো কোরআন শরিফও শুদ্ধ করে পড়তে পারে না। কিন্তু তাদের বেহেশতের পাসপোর্ট ও টিকেট ধরিয়ে দিয়েছে তাদের মোটিভেটররা।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রখ্যাত লেখক, অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরে পুনরায় সেই মাদ্রাসা তর্কটি সামনে আসছে। কেননা স্যারের ওপর হামলাকারী ফয়জুর মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। এই বিষয়টি সামনে রেখে ফেসবুকেও মাদ্রাসা শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিষোদ্গার যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে একটি রাষ্ট্রে জঙ্গি ও উগ্রবাদের বিস্তার কেন ও কীভাবে হয় এবং তার মোকাবিলা কীভাবে হবে, সেই বিষয়টি আবার আড়াল হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়।
এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমাদের জানা দরকার, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি এই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যাঁরা নিজেকে অতি প্রগতিশীল বলে প্রমাণের চেষ্টা করেন, তাঁরাও সমানভাবে ক্ষতিকর। অর্থাৎ তারা ইসলামী অনুশাসন না মানলেও এই ইস্যুতে এসে নিজেদের উগ্রবাদী ও চরমপন্থি হিসেবেই প্রমাণ করেন। অথচ আক্রান্ত হওয়ার পরে খোদ জাফর ইকবাল তার শিক্ষার্থীদের বলেছেন, ‘ওকে (ফয়জুর) মেরো না।’
‘ওকে মেরো না’… তিন শব্দের এই ছোট্ট বাক্যের অর্থ অনেক। এর ব্যাখ্যা অনেক বিস্তৃত। এর দর্শন অনেক গভীরে। কেননা অধ্যাপক জাফর ইকবাল জানেন, একজন ফয়জুরকে গণপিটুনিতে মেরে ফেললে হয়তো একটি ঘটনার বিচার হবে, কিন্তু সুনামগঞ্জের গহিন গ্রামের একজন ফয়জুর কেন এবং কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় দেশের একজন নামকরা অধ্যাপক, লেখক এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষের মাথায় ছুরি দিয়ে আঘাত করতে পারল, শত শত মানুষের মধ্যে সে এই ভয়াবহ কাজটি করার মতো সাহস ও ভরসা কোথায় পেল, ধরা পড়লে তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে এত বড় ঝুঁকি কেন নিল, সেই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে আমরা যদি ফয়জুরের মাদ্রাসাতত্ত্ব আবিষ্কার করি এবং বলি যে, মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা, তাতে ভেতরে ভেতরে এ রকম হাজার হাজার ফয়জুরের প্রস্তুত হওয়া ঠেকানো যাবে না।
জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়মিতই চলছে। হলি আর্টিজানের পরে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান হয়েছে। অনেকে নিহত হয়েছে। জঙ্গিদের মূল ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে বলে সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আরো কত ফয়জুর তৈরি হয়ে আছে এবং কাকে কাকে তারা টার্গেট করে রেখেছে, তা আমাদের জানা নেই।
কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজতে বিব্রত বোধ করি তা হলো, কেন একজন তরুণ, কেন একজন ফয়জুর এ রকম ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কী এমন মন্ত্র তাকে শেখানো হয়েছে? কে শিখিয়েছে। কোথায় এবং কীভাবে সে এই মন্ত্রে দীক্ষিত হলো? তার বাবা মা বা পরিবারের, তার স্বজনদের, তার শিক্ষকদের, বন্ধুপরিজনদের কোনো দায়িত্ব আছে?
এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলা দরকার। জাফর ইকবাল স্যার যেদিন আক্রান্ত হলেন, সেদিন এ সম্পর্কিত সংবাদের নিচে বিভিন্নজন যেসব মন্তব্য করেছেন, তার মধ্যে অনেকগুলোর ভাষা এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল, যেগুলো ছুরি দিয়ে জাফর ইকবালকে আহত করার চেয়ে কম নয়। বহু লোক এই হামলাকে সমর্থন করেছে। ‘ভোঁতা ছুরি নিয়ে তুই কেন মারতে গেলি’––এ রকম বীভৎস মন্তব্যও দেখেছি। কারণটা কী? ওই মন্তব্যকারীদের পরিচয় যাই হোক, ধরে নিচ্ছি তারা অর্ধশিক্ষিত, ধরে নিচ্ছি তাদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, ধরে নিচ্ছি তারা জাফর ইকবালের লেখা পছন্দ করে না, ধরে নিচ্ছি তারা উগ্রবাদী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করে–এত কিছু ধরে নেওয়ার পরও এই প্রশ্নটি আমাদের মনে উঁকি দেয় যে, জাফর ইকবালের মতো একজন নিপাট ভদ্রলোক, সংবেদনশীল মানুষ, যাকে লাখ লাখ তরুণ আদর্শ বলে মানে, সেই মানুষটির আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে কেন কিছু লোক আনন্দ প্রকাশ করছে? সেই লোকগুলো কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছে? সেই লোকগুলো কি আমাদেরই ভাই, বন্ধু, স্বজন নয়? তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
কেন তারা মনে করে জাফর ইকবালকে হত্যা করা সংগত? সমাজের একজন মানুষও যদি এটি মনে করে, তাহলে বুঝতে হবে সমাজের গভীরে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি হয়ে আছে। সেই ক্ষত সারানোর জন্য রাষ্ট্র কী করেছে? গালাগাল বা বিষোদ্গার যে সমস্যার সমাধান আনে না বরং একটি জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে, তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে।
যখনই এ রকম উগ্রবাদী ঘটনা ঘটেছে, তার প্রথম আক্রমণের শিকার হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ফলে মূল সমস্যাটা আড়াল হয়ে গেছে। অন্য কেউ এই ঘটনা ঘটালেও তার দায় পড়েছে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাঁধে। ফলে তারা আরো বেশি জনবিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিক হয়েছে। এদের মূলধারায় নিয়ে আসার চেষ্টাটা বহু বছর হয়নি। সম্প্রতি সরকার সেই চেষ্টাটি শুরু করেছে। কোন প্রক্রিয়ায় এটি হচ্ছে বা হওয়া উচিত, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু উদ্যোগটা ভালো। কারণ যখন একটি জনগোষ্ঠী দেখবে তার জন্য রাস্তায় নেমে ভিক্ষাবৃত্তি আর মাইক লাগিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চাঁদা তোলা কিংবা বড় জোর বাড়িতে গিয়ে মিলাদ পড়ানো অথবা মসজিদে আজান দেওয়া ছাড়া তার জন্য আর কোনো সম্মানজনক কাজের নিশ্চয়তা নেই; তখন সে মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার আশপাশের সবাইকে তার চেয়ে প্রিভিলেজড ভাবে এবং সব সময় একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে তাকে সহজেই বেহেশতের হুর-পরীর লোভ দেখিয়ে জাফর ইকবাল কিংবা হুমায়ুন আজাদের শরীরে ছুরি কিংবা চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়ানো যায়। এতে লাভবান হচ্ছে কে?
দেশের একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে ছুরিকাঘাত করল সেখানে রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? আমাদের রাষ্ট্র কি সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে? এই রাষ্ট্রযন্ত্র কি আমাদের জন্য একটি বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ গড়ে তোলার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছে? আমাদের রাষ্ট্র কি শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছে? রাষ্ট্র কি চাকরি-বাকরিসহ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা জিইয়ে রাখেনি? এই রাষ্ট্র কি রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসের নামে, মতভিন্নতার নামে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে দুটি প্রকাশ্য ভাগে বিভক্ত করে রাখেনি? ফলে যতক্ষণ না আমরা একটি মানবিক, বৈষম্যহীন আর সহনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারছি, ততক্ষণ একজন দুজন ফয়জুরকে ধরে তার বিচার করা যাবে ঠিকই, ভেতরে ভেতরে এ রকম আরো অনেক বিপথগামী তরুণের জন্ম হতে থাকবে।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।