বই হোক প্রিয় সঙ্গী
বই মানুষের খুব কাছের বন্ধু। বই আনন্দের প্রতীক। আর এখন চলছে অমর একুশের গ্রন্থমেলা। অনেকেই বই কিনতে যাচ্ছেন বইমেলায় আবার কেউবা যাচ্ছেন শুধু ঘুরতে। আজকাল শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্যও অনেকে বইমেলায় যান! কিন্তু বইপাঠ একজন মানুষকে মুক্তচিন্তার অধিকারী করে দেয়, করে দেয় আলোকিত।
একবার যদি আপনার বইপড়া অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে আপনার সৃজনশীল মানসিকতার বিকাশ ঘটবে খুব সহজেই। এমনকি চিন্তাশক্তি হয়ে উঠবে সবল। কাজেই নিজের যেমন বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে তেমনি সন্তানদের মধ্যেও এই চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।
সন্তানের হাতে বই তুলে দিন
বই পড়ে একজন মানুষ তার চিন্তার পৃথিবীকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পারেন। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে বেশি করে বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। এ জন্য বই পড়ার অভ্যাস আগে আপনাকেই আয়ত্ত্ব করতে হবে এবং নিজের সন্তানকেও বই পড়তে উৎসাহ দিতে হবে।
স্কুল-কলেজে যেমন নোট আদানপ্রদান করতেন, তেমনই খুঁজে নিন আপনার বই বন্ধুকে, লেনদেন করুন বই। হতে পারে দুজনের একই বই পছন্দ। তাহলে চেষ্টা করুন এক সময়ে একই বই দুজনে পড়ার। অথবা একে অন্যের পছন্দের বইও পড়তে পারেন। দেখবেন বই পড়ার উত্সাহ আরো বেড়ে যাবে।
কথাসাহিত্যিক নাসরিন জাহান বলেন, ‘বই পড়া ভালো। তার মানে এই নয় যে আজেবাজে সব বই-ই পড়তে হবে। যদি কেউ না বোঝে কোন বইটি ভালো তাহলে তার কাছের পরিচিত কাউকে খুঁজে নেওয়া উচিত যে বই পড়তে ভালোবাসে। তার কাছ থেকে বই সম্বন্ধে সে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে। কারণ না বুঝে বই পড়লে কয়েকপাতা পড়ে আর সেই বই ভালো লাগবে না এবং অন্য কোনো বইপড়ার আগ্রহও সে হাড়িয়ে ফেলবে।’
নাসরিন জাহান আরো বলেন, ‘যেদিন থেকে আপনার সন্তান বুঝতে শিখবে সেদিন থেকে বইয়ের সঙ্গে তার সক্ষতা গড়ে দিন। তার বয়স অনুযায়ী তাকে বই পড়তে দিন। এক সময়ে সে নিজেই আগ্রহ খুঁজে পাবে। আর বইয়ের স্বাদ খুঁজে পেলে সে নিজে নিজেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে।’
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার এ ব্যপারে বলেন, ''ছোটবেলা থেকেই শিশুর হাতে বই তুলে দিতে হবে। তাকে মুখে গল্প শোনাতে হবে। আজকালকার শিশুরা বইয়ের থেকে টিভি, কম্পিউটারের প্রতি আসক্ত বেশি হচ্ছে। তারা যদি বই না পড়ে, গল্প না শোনে তাহলে তারা প্রশ্ন করতে শিখবে না। আমি যদি আমার বাচ্চাকে বলি, এক দেশে এক রাজা ছিল....তাহলে সে আমাকে প্রশ্ন করবে বাবা রাজা কী? অথবা যদি বলি দৈত্য এসে রাজকুমারীকে ধরে নিয়ে গেছে....তাহলে তার মনে প্রশ্ন জাগবে দৈত্য কী? তখন সে কৌতূহলী হয়ে উঠবে এবং আমার কাছে জানতে চাইবে। আর এ থেকেই তার মধ্যে জানার আগ্রহ তৈরি হবে।’
তুষার আরো বলেন, ‘আমি দুইটা কারণের জন্য সবাইকে বই পড়তে বলব, একটা হলো একাকীত্বের সঙ্গী বই আর দ্বিতীয়টি হলো বই মানুষের কল্পনার জগতকে সম্প্রসারণ করে। মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতা বইয়ের কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকে।’
উপহার দিন বই
অনেকে আজকাল আর কাউকে বই উপহার দেয় না। বই মানুষের মনকে সুন্দর করে। তাই আবদুন নূর তুষার মনে করেন, মানুষের মনকে সুন্দর করার জন্য বই হলো সবচেয়ে ভালো উপহার।
কথাসাহিত্যিক নাসরিন জাহান বলেন, ‘অনেকে মনে করেন বই এখন আর কোনো উঁচু মানের উপহার না। তাই এখন আর কোনো অনুষ্ঠানে কেউ বই উপহার দেয় না। অথচ আগেরকার দিনে মানুষ কাউকে উপহার দেওয়ার কথা চিন্তা করলে বইকে বেছে নিত। এখনো অনেকে আছেন যাঁদের কাছে ৪০ বছর আগের উপহারের বই খুঁজে পাওয়া যায়।’
তাই নিজেকে বড় প্রমাণের জন্য ভারী ভারী উপহার না দিয়ে বইকেই উপহার হিসেবে বেছে নিন। মনে রাখবেন বই পেলে কেউ অখুশি হয় না। বরং কেউ কেউ এমনও আছেন অনেক উপহারের মাঝে শুধু বইকেই হাতরে বেড়ান।
বইয়ের জন্য সময়
অনেকেই আছেন যাঁরা ব্যস্ততার চাপে বইয়ের জগৎ থেকে হারিয়ে গেছেন। অথচ এই মানুষগুলো একসময় ছিলেন বইয়ের পোকা। আজ যাঁরা কজের চাপে বই পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত তারা কিছুটা হলেও সময় বের করে বই পড়ার চেষ্টা করুন।
ছোটবেলায় যেমন রুটিন মেনে পড়াশোনা করতেন সেভাবে আপনার রোজকার রুটিনে ১৫ থেকে ২০ মিনিট বরাদ্দ রাখুন বই পড়ার জন্য। অফিসে এক নাগাড়ে কাজ করতে করতে যখন একঘেয়েমি লাগে তখন সেই সময়টাতে বই পড়ুন। দেখবেন, ভালো লাগবে।
অথবা ফোন, ট্যাব বা ই-বুক রিডারে সেভ করে নিন পছন্দের বইটি। অনেকে মনে করেন ইন্টারনেটে বই পড়ার অভ্যাস কমিয়ে ফেলে। এ ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। বই পড়ার অভ্যাস থাকলেই হলো। কর্মস্থলে যাওয়া আসার পথে পড়তে পারেন বই বা ই-বুক।
দিনের বেশির ভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যস্ত না থেকে সেই সময়ে পছন্দের বইটির দুপাতা পড়ে ফেলুন। দেখবেন কয়েকদিনে মধ্যে আপনার অজান্তেই বইটি পড়া হয়ে গেছে।
অথবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুলিয়ে নিন পছন্দের বইয়ের পাতায়। আর আপনার সঙ্গী যদি হয় বইপ্রেমী তাহলে দুজনে মিলে একসঙ্গে পছন্দের বই পড়তে পারেন।
ঘুরে আসুন বইমেলা থেকে
কথাসাহিত্যিক নাসরিন জাহান বলেন, ''বই মানে আমি বুঝি- দেখলাম, কিনলাম এবং পড়লাম। তাই আমি সবাইকে পরামর্শ দিব বই কেনার অভ্যাস করুন এবং বই পড়ুন। আর বইমেলা বই কেনার উপযুক্ত জায়গা। যেখানে সব ধরনের বইয়ের সন্ধান পাবেন। বই হাতে না নিলে বইমুখী হবে কীভাবে? তাই মেলায় ঘুরতে ঘুরতে অন্তত একটি বই কিনুন, এটাই আমার অনুরোধ।''
মনোচিকিৎসক মুহিত কামাল বলেন, ‘আমি মনে করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে বইমেলায় ঘুরতে আসা একটা প্রাণচ্ছল ব্যাপার। স্টলে স্টলে মা-বাবার হাত ধরে শিশুরা এখন বইমেলায় ঘুরতে আসে। এখন গতানুগতিক ধারা থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। আবার কারো হয়তো অনেক বই কেনার সামর্থ্য নেই। তবুও তারা মেলায় এসে এসব বইয়ের তালিকা নিয়ে যায়। যাতে সারা বছর সে এই বইগুলো আস্তে আস্তে কিনে পড়তে পারে।’
মুহিত কামাল আরো বলেন, ‘মানুষের মধ্যে বই পড়ার প্রেষণা জাগাতে হবে। প্রেষণা মানে হলো- উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও আগ্রহ। যা বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। এবং ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করে।’
তাই নিজে বই পড়ুন এবং নিজের সন্তান ও আশপাশের পরিচিতজনকে বই পড়তে আগ্রহী করে তুলুন।